আম-লিচুর ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না বাগান মালিকরা

63

আম-লিচু বাজারজাতকরণে ক্রেতা খুঁজছেন বাগানের মালিকরা, কিন্তু পাচ্ছেন না। আম-লিচুসহ মৌসুমি ফল বাজারজাতকরণের আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত সরকারের কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কৃষিমন্ত্রীর প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ‘ফুড ফর ন্যাশন’ উদ্বোধন করা হলেও নিশ্চিত করা যায়নি কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন ও ন্যায্যমূল্য। অথচ চাহিদা মোতাবেক সহজলভ্যতা তৈরি এবং জরুরি অবস্থায় ফুড সাপ্লাই চেইন অব্যাহত রাখতেই বাংলাদেশের প্রথম উন্মুক্ত কৃষি মার্কেট অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ফুড ফর ন্যাশন’ চালু করা হয়েছিল। এর মাধ্যমেই সরকার আম ও লিচুর বাজারজাতকরণের সাপ্লাই চেন ঠিক রাখতে চেয়েছিল। এতে আম ও লিচু চাষিদের চিন্তা করতে হবে না বলে সরকার মনে করলেও উৎপাদিত পণ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা কমেনি বলে অভিযোগ কৃষকদের।- বাংলা ট্রিবিউন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের আম চাষি ফজলুল হক বলেন, করোনার কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এবার আমের ব্যাপারীরা এলাকায় আসেনি। আমরাও বাগানের আম বিক্রি করতে পারিনি। বাগান কিনেছি অনেক টাকা দিয়ে। ব্যাপারীরা আসতে না পারলে আর ট্রাক চলাচল স্বাভাবিক না হলে আমরা কীভাবে আম বিক্রি করবো তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে নাকি আম-লিচু বাজারে বিক্রি করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমরা কিছুই জানি না, কেউ এখন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
দিনাজপুরের লিচু চাষি খায়রুল আলম বলেন, লিচু খুব কম সময়ের জন্য বাজারে আসে। লিচু গাছে পাকা শুরু করলে তা সময়মতো বিক্রি করতে না পারলে সব নষ্ট হয়ে যায়, লিচু গাছের বোঁটা থেকে ঝরে যায়। তাই সময়মতো লিচু বিক্রির জন্য খরিদদার না পেলে আমরা তো মরে যাবো।
এদিকে সরকারের পক্ষে গত ১৬ মে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আম, লিচুসহ মৌসুমি ফল এবং কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অনলাইনে মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। উপস্থিত কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টরা দশ দফা সুপারিশ করেছেন। আম-লিচুসহ মৌসুমি ফল বাজারজাতকরণে ১০ দফা সুপারিশ হচ্ছে :
১. হাওরে ধান কাটা শ্রমিকদের যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠানো হয়েছে, তেমনি অন্যান্য জেলা হতে ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ফড়িয়াদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা, প্রয়োজনে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রত্যয়নপত্র প্রদান ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা নেওয়া।
২. মৌসুমি ফল এবং কৃষিপণ্য পরিবহনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহনের অবাধে যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা, পরিবহনের সময় যাতে কোনও হয়রানির শিকার না হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাধ্যমে সে ব্যবস্থা করা।
৩. বিআরটিসির ট্রাক ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া।
৪. স্থানীয়ভাবে ব্যাংকের লেনদেনের সময়সীমা বাড়ানো।
৫. পার্সেল ট্রেনে মৌসুমি ফল এবং কৃষিপণ্য পরিবহনের আওতা বাড়ানো, হিমায়িত ওয়াগন ব্যবহার করা যায় কিনা তা নিশ্চিত করা।
৬. ফিরতি ট্রাকে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল হার কমানো।
৭. ত্রাণ হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীতে আম-লিচুসহ মৌসুমি ফল অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো।
৮. অনলাইনে এবং ভ্যানযোগে ছোট ছোট পরিসরে কেনাবেচার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৯. প্রাণ, একমি, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠান যারা কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে জুস, ম্যাঙ্গোবার, আচার, চাটনি প্রভৃতি তৈরি করে, তাদের এবছর বেশি বেশি আম-লিচু কেনার অনুরোধ জানানো।
১০. মৌসুমি ফলে যেন কেমিক্যাল ব্যবহার করা না হয় সেজন্য জেলা প্রশাসন, কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতর এবং কৃষি বিপণন অধিদফতর সমন্বিতভাবে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা।
এই দশ সুপারিশের মধ্যে ইতিমধ্যে দুটি সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে, বাকি সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য রবিবার (৩১ মে) থেকে কাজ শুরু হবে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান। তিনি জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জনসাধারণকে দেওয়া ত্রাণ সামগ্রীতে আম-লিচু অন্তর্ভুক্ত করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় বাজারজাতকরণ সহজ করতে আম-লিচু পরিবহনে ব্যাপারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (২৮ মে) দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে আম-লিচু বরাদ্দ দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, ত্রাণ সামগ্রী হিসেবে শাকসবজি, আম ও লিচু কিনে বিতরণ করা যেতে পারে। প্রত্যেক ত্রাণ গ্রহণকারীকে কমপক্ষে পাঁচটি করে গাছ লাগানোর অনুরোধ করা যেতে পারে।
এদিকে বর্তমানে লকডাউন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ফলের ব্যাপারী বা ফড়িয়ারা বাগানের মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। ব্যাপারীরা যাতে কোনও প্রকার বাধা ছাড়া নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারেন, সে ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সে বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন বাগান মালিকরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান জানিয়েছেন, বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে আম-লিচুসহ মৌসুমি ফল উৎপাদনকারী কৃষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করার ক্রেতা পাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় ব্যাপারী বা খরিদদারদের সঙ্গে বাগান মালিকদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেই। সরকার যদি এটি পারে তাহলে কৃষকরা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারবেন। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের উৎপাদিত ফল বাজারজাতকরণে উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। পথে যাতে কোনও সমস্যা না হয় সেজন্য জেলা প্রশাসন থেকে টোকেন দেওয়া যেতে পারে। এসব ব্যবস্থা করতে পারলে কৃষকরা উপকৃত হবেন।