‘আমি মানি না কো কোন আইন…’

318

পর্ব-২
তারপর বসে বসে ভাবছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার সুযোগ্য ভাতিজাদের কথা। বড়ই জ্ঞানী ছেলেরা নতুন নতুন নামতা আবিস্কার করছে, মনে হয় পীথাগোরাসের খেলাফত পেয়েছে। শুধু নামতা না, নামতা বলার নিয়মও বের করেছে। নিয়ম একটা জেনেছি, প্যাকের নামতা, শার্ট খুলে পড়তে হয়। এখন প্যান্ট খুলে পড়ার নামতা কোন আছে নাকি সে কথা চিন্তা করছিলাম। কারণ আমাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালে নামতা বলতে না পারলে ভাতিজারা আবার মাইন্ড করতে পারে। তাই ভাল করে শিখিয়ে-পড়িয়ে ভার্সিটির যোগ্য করে তাদের পাঠানোর চিন্তায় যখন মশগুল তখন দেখি রাজশাহী পলিটেকনিকের অধ্যক্ষ ফরিদ চাচাকে ভাতিজারা পুকুরে চালান করেছে! মাশাল্লাহ্ হাহাহাহা, আমার যোগ্য ভাতিজারা সবদিক থেকে দেখছি সুযোগ্য হয়ে উঠছে। ভরসা ছাড়া চিন্তা নাই ভাতিজা আছে ভয় নাই। ফরিদ চাচাও দেখছি বড় বেরসিক মানুষ কেবল আইন-কানুন দেখান। আরে- নাই আইনের দেশে এত আইন দেখানোর কি দরকার? যেখানে আমাদের জাতীয় কবি আইন মানেন না সেখানে আপনি চাচা কোন খাঁচার বাঘ হয়েছেন যে, একদম আইনের জন্য সাইন করতে পারছেন না? বেশী কিছু তো চায় নি আমার ভাতিজারা আপনার কাছে, মাত্র সেমিস্টার-ফরম পূরণ করতে চেয়েছিল। তাতেই আপনি তাদের সামনে একেবারে আইনের লাইন ধরাই দিলেন? উপস্থিতি আইনের ফাঁদে ফেলে তাদের ফরম পূরণ করতে দেন নি, ওরে মহা আইনবিদ রে! আরে ভাই ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে কি হয়, একদম কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েযায় যে?নিউটন কি গাছতলে বসে ক্লাস করেননি, মাধ্যাকর্ষণ কি খুঁজে পাননি? বড় আইন দেখাচ্ছেন, আইনস্টাইনকে আইন দেখান। সেটাও তো পারবেন না, কারণ তিনি বলেছেন বইতে যা আছে তা তিনি কষ্ট করে মুখস্ত করেন না। না জেনে না বুঝে কাম কতগুলা করেন আর দোষ হয় আমার ভাতিজাদের।
আমার ভাতিজারাও দেখি সিস্টেম জানে।ফরিদ চাচা যোহরের নামাজ পড়ে আসছেন, ভাতিজারা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। চাচা নিকটে আসতেই ধরে তাঁকে ভাতিজারা সোজা পুকুরে। সিস্টেম দেখে আমার বাল্যকালের কথা মনে পড়ে গেল। আমরা বালকের দল এক সাথে থাকতাম, কেউ আমাদের কারো সাথে যদি কখনো তাফালিং করত, সবাই মিলে কষে ধোলাই দিতাম। একদিন আমাদের একজনের সাথে তাফালিংকারী একছেলে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে আমরা চার-পাঁচজন মিলে খেলা করছি, তাকে আসতে দেখেই আমরা খেলা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে কল্লা নেড়ে নেড়ে হাসছি। তার মানে আয় ভাগিনা আজ পাইছি তোরে। সে’ও দেখি আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, কিন্তু চাটু-হাসি। উপায় নাই কারণ বাড়ি তার এদিকে। কাম হয়নি, আমরা হাসতে হাসতে সেরে ফেলি আমাদের কারবার। সে দৃশ্যটা আমার এখানে মনে পড়ে গেল, চাচার মুখে তাফালিংকারীর হাসি আর ভাতিজাদের মুখে আমাদের হাসি; আয় চাচা আজ পাইছি তোরে। না ঠিক আছে কাম সারি ফেলছে, আমাদের দেশের নাম করা ছাত্র সংগঠনের ভাতিজা তারা সাত খুন মাফ তাদের জন্য। কিন্তু সেখানে দেখলাম ভাতিজা একটার নাম আবার মেহেদী হাসান, মাশাল্লাহ্। নামটি দেখলে আমি একটু নস্টালজিক হয়ে পড়ি আরকি, কারণ আমার পছন্দের তালিকায় তিনি আবার এক নম্বরে আছেন তো। বড়ই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, ফুটবল স্টার, টেলিভিশন স্টার, সিনেমা স্টার সহ কত স্টার যে আছে তার কোন সীমা নাই। কিন্তু মেহেদী হাসান নামে যত মানুষ আছে তার এক আনাও অন্য সেলিব্রেটির নামে আছে কিনা জানিনা। আবরার হত্যাকারী ২৫ জনের মধ্যে দুজনের নাম দেখলাম মেহেদী হাসান। খেলোয়াড় আছে মেহেদী হাসান মিরাজ, পুলিশেও আছে দেখি অনেক মেহেদী হাসান। পুলিশ, খেলোয়াড়, অফিসারের নাম মেহেদী হাসান ঠিক আছে,কিন্তু খুনী, বাটপার, সন্ত্রাসীর নাম মেহেদী হাসান দেখলে একটু খারাপ লাগে আরকি।
বাংলাদেশে খুঁজ নিয়ে দেখুন অন্তত কয়েক লক্ষ মেহেদী হাসান পাবেন। ভেবে দেখুন তাহলে তাদের বাপ-দাদার কাছে তিনি কত জনপ্রিয় ছিলেন? আহ্ কি চমৎকার সুর, দুনিয়া কিসিকে পেয়ার মে- কলিজা থেকে হৃদয় একদম কেড়ে নেয়। হায় তাঁর প্রশ্ন হলো, দুনিয়া কিসের জন্য প্রিয়? আর আমাদের মেহেদী হাসানদের উত্তর হলো, দুনিয়া টাকার জন্য প্রিয়, দুনিয়া ক্ষমতার জন্য প্রিয়। অতএব তারা তাদের ক্ষমতা দেখাল শিক্ষককে পানিতে ফেলল। তো এখানে একটি কথা মনে পড়ে গেল, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম কতবার যে স্কুলের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম স্যারের ভয়ে তার হিসাব নাই। এখন ছাত্রের ভয়ে স্যাররা ক’বার ঝাঁপ দেন সেটাই গণবার চাই। ঠিক আছে সমস্যা নাই সেই আশাতে দিন কাটাই, কিন্তু এদিকে হোসাইন ভাতিজা কহিল জামাল খানে নাকি ওয়াসার কোপে কম্পন উঠেছে। আমরা তো জানি যেখানে সুচ চলে না সেখানে ওয়াসা কুড়াল চালায়, সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়। নালাকে খাল বানায় ফলে গোটা শহরের অবস্থা এখন ত্যাড়া-বেড়া। বলে লাভ নাই কারো কোন হুঁশ নাই, মেতে কোন কাম নাই তাই কেউ মাতে না। কি মাতবে, কথা কেউ কানে নিলেই তো মাতবে। ফলে কিছুক্ষণ খালি খালি চিৎকার করে সবাই চুপ হয়ে যায় তাই আমরাও চুপ হয়ে রই। কিন্তু জামাল খানÑ সে তো খবর পাড়া, সংবাদের জন্ম হয় সেখান থেকে, খোদ প্রেসক্লাবের অবস্থান সেখানে। যত আন্দোলন, প্রতিবাদ, মানববন্ধন সব সেখান থেকে শুরু হয়, দাবী আদায়ের সুতিকাগার। একটি পাথর পড়লে রীতিমত সেটা একটা বোমা হয়ে ফাটে যেখানে, সেখানে যখন নালাকে নদী বানাতে কোন তোয়াক্কাই করে না, অন্য জায়গাকে তখন আর কি পাত্তা দেবে ওয়াসা। জামালখানে অনিয়ম করা মানে, থানায় গিয়ে চোর পুলিশের পকেট কাটা বা বাঘের খাঁচায় ঢুকে বাঘকে খামচি মারা। কি করব? জামানা খারাপ, চোর কতোয়াল বায়, গোলাম হোসেন উপায় নাই। ওয়াসার জন্য ওসব কোন ব্যাপার নয়। ১ দিনে যারা ২৯ ঘণ্টা কাজ করে তারা কি না পারে? এখন ভাবছি ১ দিনে কয় ঘণ্টা, হাহাহাহা।
ভাতিজা হোসাইন আরো জানালো, নগরীতে বহুতল ভবন নির্মাণে আইন-নিয়মের তোয়াক্কা নেই। হায়রে ভাতিজা এটা কি বললা, যেন নতুন কথা শুনাইলা। আরেÑ আইন না মানাই তো এখানে আইন, পুরাণ কথা। সারা দেশ ঘুরে কোথাও কি দেখাতে পারবে কেউ কোন আইন মানছে? সাধে নি আমি নজরুলকে স্মরণ করছি, আমি মানি নাকো কোন আইনÑ? বহুতল ভবন নয় শুধু, খালি জায়গাতেও কেউ আইন মানে না। সবাই চায় কেবল টাকার কানন আর তুমি চাও ভাতিজা আইন-কানুন। কি করবে এত আইন খুঁজে? এই তো সেদিন জাতীয় এক পত্রিকায় দেখলাম দেশে তাঁতী লীগ আর তাঁতী দলের আকার খালি বড় হচ্ছে! আশ্চর্য, দেশে তাঁতই নাই এত তাঁতী তারা কোথায় পায়? অবশ্য পত্রিকাটি বলেছে তাঁতশিল্পের বিকাশে উক্ত সংগঠন দু’টির কোন ভূমিকাই নাকি নাই। তাহলে তারা খালি তাঁতী বানায়, কিন্তু তাঁত তো নাই। এ তাঁতী নেবে কোথায়?তাহলে ভাবুন কে মানছে আইন-কানুন? এদিকে বরগুনার এক ভাতিজা জানালো, রিফাতহত্যা মামলায় পুলিশ নির্যাতন করে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে নাকি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করছে। সুতরাং আইন-শৃঙ্খলার তোয়াক্কা এখন কোথাও নাই, সবাই এখন করে ভাই যখন চাহে তার মন যা। আপন আপন করিস যারে সে তো তোর আপন নয়। ঠিক তেমন আইন আইন বলিস যত আইনও তোর আপন নয়। তবে আপনের কথা বলতে গিয়ে পাপনের কথা মনে পড়ে গেল। মাশাল্লাহ্পাপন চাচা খাইছে নাকি সাকিব ভাতিজার কল্লা। ফেবু, মিডিয়া তো পুরা ঝড় তুলেছে তাদের নিয়ে। সবাই বলে পাপন নাকি কি করেছে গোপন। পাপন বলে, আমি তোমাদের আপন, করিনি কিছু গোপন, তোমরা আমার স্বপন, দিওনা মোরে কাফন, আমি তোমাদের পাপন।
পাপন চাচাকে আর না ঘাঁটি ট্রাম্প চাচাকে দিয়ে লিখা শেষ করি। আমরা সকলেই আইনকে অমান্য করতে চাই, আইন ফাঁকি দিতে চাই, আইনের ফাঁকে কখনো পড়তে চাইনা। এক ভাতিজার কাছে জানতে পারলাম ট্রাম্প চাচা নাকি নিউইয়র্ক ছেড়ে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ নিউইয়র্কের রাজনীতিবিদরা নাকি তাঁকে ভীষণ জ্বালাতন করছেন। দুঃখের কথা, প্রতিবেশীর জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করতে হচ্ছে! কিন্তু আসল গুমর ফাঁস করল বজ্জাত নিউইয়র্ক টাইমস। অত্যন্ত খারাপ, এই পত্রিকাটি মানির মান রাখতে জানেনা। প্রেসিডেন্টের নামে কুৎসা রটাচ্ছে, তিনি নাকি করের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে নিউইয়র্ক ত্যাগ করছেন। নিউইয়র্কে নাকি বাসিন্দাদের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় উভয় সরকারকে কর দিতে হয়। ফ্লোরিডায় স্থানীয় সরকারকে কোন কর দিতে হয়না। আশ্চর্য, নিউইয়র্কে স্থানীয় সরকারের সে করের পরিমাণ কত যার জন্য একজন প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত নিজ জন্মস্থান ত্যাগ করার কথা চিন্তা করতে হয়? আইন যদি তেমন হয় সকলেই তো তবে তা ফাঁকি দিতে চাইবে। সেজন্যেই তো নজরুল আইন না মানার কথা বলেছেন। সুতরাং তাঁর দোষ দিয়ে আর লাভ কি? একটি কথা, যে ছেলেটিকে আমরা মেরেছিলাম ছোট বেলায়, সে আজ আর বেঁচেনেই। বছর দুই হয় মৃত্যুবরণ করেছে, আল্লাহ্ তাকে বেহেস্ত নছিব করুন, আমিন। পরে তার সাথে আমাদের সম্পর্ক গভীর হয়েছিল। বর্তমানে এমন হয় না, আমাদের ঝগড়া শেষ হত সবরে এখন শেষ হয় কবরে !
লেখক : কলামিস্ট