আমি বিজয় দেখেছি

54

অনেক দিন আগের কথা। সেই ১০৭১ সাল। তখন বিজয়ের জন্ম হয়নি।
একাত্তরের শুরুতে ছিল পাকিস্তান। অর্থাৎ পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিমের ভাষা উর্দু। আর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভাষা বাংলা। এ ছাড়াও শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি সবই ভিন্ন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অসমতা ছিল বিশাল। সরকার চলতো পশ্চিমের নির্দেশে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনা আর বৈষম্য ছিল অবিরাম। এসব বিভিন্ন কারণে পূর্বপাকিস্তানের জনগণ হতাশায় ডুবেছিল।
কিন্তু সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর বাংলার জনগণ আশার আলো দেখতে পায়। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের এই জয় সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ওরা ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। এ নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের বড় ফাটল ধরে।
ক্রমে বাঙালিরা ফুঁসে ওঠে। নেতা শেখ মুজিব একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন। অগ্নিঝরা সেই ভাষণ ছিল একটি ঐতিহাসিক ভাষণ। শেখ মুজিব সেদিন ঘোষণা দেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
নেতার নির্দেশে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় সেই মার্চ মাসের গোড়ার দিকে। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বানিজ্য সব স্থবির হয়ে পড়ে।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী “অপারেশন সার্চ লাইট” ঘোষণা দিয়ে নিরীহ-নিরস্ত্র জনগণের ওপর নৃশংস হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্র-শিক্ষক জনতাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। জ্বালিয়ে দেয় পুলিশ ব্যারাক। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের ছাউনিতে হামলা চালিয়ে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করে বন্দী করে। শহরের ঘন বসতি এলাকাগুলোতে আক্রমণ চালায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে নেতা শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
তখন বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণের ওপর দায়িত্ব বর্তায় দেশকে মুক্ত করার। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় অধিকাংশ জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চায়।
২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের এই স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রথম প্রচার করা হয়। সাহসী ও অকুতোভয় কয়েকজন বেতার কর্মী ও সংস্কৃতি কর্মী একত্র হয়ে “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামে খুবই স্বল্পস্থায়ী বেতার সম্প্রচার শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই বেতার কেন্দ্রটি “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” রূপে এই সম্প্রচার চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন আর নির্বিচার হত্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। শহর ছাড়িয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। সেনাদের অগ্নিসংযোগে গ্রামের পর গ্রাম জ্বলতে থাকে। ভীত-সন্ত্রস্থ নিরীহ জনগণ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সীমানা পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। তৎকালীন ভারত সরকার মানবতা বিবেচনা করে উদ্বাস্তু-অসহায় জনগণকে শরণার্থীরূপে গ্রহণ করলো।
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননকে “মুজিবনগর” নামরকরণ করে সে স্থানে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়।
বাংলার কিশোর, তরুণ, যুবক আর বৃদ্ধরা দলে দলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেয়ার জন্য যোগ দিতে থাকে। ওরা সবাই “গেরিলা” হতে চায়। ওরা চায় দেশকে হানাদার মুক্ত করতে। দেশের জন্য প্রাণ দেয়ার শপথ নিয়ে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। শুরু হয়ে যায় গেরিলা যুদ্ধ। রাইফেল আর গ্রেনেড হাতে পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রæ সেনাদের ঘায়েল করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আরো কিছু পরে প্রাক্তন ই.পি.আর বাহিনীর সদস্যরা মেশিনগান, সাব-মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্র নিয়ে মুক্তি সেনাদের সাথে যোগ দেয়।
যারা স্বাধীনতা চায় না, তারা পাকিস্তানীদের পক্ষে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী গঠন করে। তাদের যৌথ উদ্যোগে শুরু হয় গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুট এবং অগ্নিসংযোগ।
মুক্তিকামী গেরিলারা দমার পাত্র নয়। তাদের গুপ্ত আঘাতে শত্রæপক্ষের যেমন ক্ষতি হয়, ঠিক তেমনি নিজেদেরও আঘাত সইতে হয়। এভাবেই দিন যায়। মাস অতিক্রান্ত হয়। স্বাধীনতা ঘোষণার নয় মাস পর একাত্তরের তিস্রা ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলার মুক্তিসেনাদের সাথে যোগ দেয়। মিত্র বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে আঘাত হানা হয় পাকিস্তানীদের ওপর।
১৪ ডিসেম্বর আল-বদর, আল-সাম্স আর রাজাকার বাহিনী বাংলাকে মেধাশূন্য করার জন্য বাংলার বহু বুদ্ধিজীবী হত্যা করে।
কিন্তু এরপরও হানাদার বাহিনী নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হলো না। তারা পর্যুদস্ত হলো। যৌথ বাহিনী তাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণের আহবান জানাল।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ভোরের সূর্যোদয়ে জন্ম নিল বাংলাদেশের “বিজয়”! পাকিস্তানী পরাজিত সৈন্যরা রেসকোর্স ময়দানে অস্ত্র নামিয়ে আত্মসমর্পণ করল যৌথ বাহিনীর কাছে।
মুক্তিকামী বাঙালিরা দলে দলে রাজপথে নেমে এলো। তাদের চোখে মুক্তির আনন্দ! মুখে “জয় বাংলা” সেøাগান। হাতে লাল-সবুজ পতাকা। লাল বৃত্তে বাংলাদেশের মানচিত্র!