আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

157

মহান স্বাধীনতা দিবস। উচ্ছ্বাস আর আনন্দের দিন। বাঙালি জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের দিন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের আনুষ্ঠানিকযাত্রার দিন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছি এই স্বাধীন বাংলাদেশ। দখলদার, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, ক্ষমতালিপ্সু পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ করে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। ২৬ মার্চ আমাদেরকে বিপ্লবী সংগ্রামের প্রেরণা যোগায়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাসের এক অনিবার্য পরিণতির শুরুর দিন।
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখন্ডের নাম জানান দেয়ার দিন। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্ব প্রকাশের অবিস্মরণীয় দিবস। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। ৪৯ তম স্বাধীনতা দিবসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা স্মরণ করছি সেই সব শহীদদের, যাঁরা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এই লাল-সবুজের পতাকা দিয়েছেন। স্মরণ করছি ৩০ লাখ শহীদকে, যাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। স্মরণ করছি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। স্মরণ করছি সেই সময়ের কোটি কোটি মানুষকে, যাঁরা হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন সইতে না পেরে ঘরবাড়ি ছেড়ে পরবাসী হয়েছিলেন, বনে-জঙ্গলে রাত কাটিয়েছেন, নিজে না খেয়েও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে একবেলা খাওয়ানোর জন্য ব্যাকুল থেকেছেন।
অনেকগুলো দিন নিয়ে বছর। অনেক বছর নিয়ে যুগ, শতাব্দী। এ সব দিন অলক্ষ্যে চলে যায়। কিন্তু এর মধ্য থেকে একটি দিন স্মৃতিময় হতে থাকে, স্মরণে উজ্জ্বলতা দেয়। আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার ২৬ মার্চ তেমনি একটি দিন। এ দিনের স্মৃতি আমাদের মানসে চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আমাদের জাতিসত্বার অবিচ্ছেদ্য অংশ এই দিন। একারণেই এই দিবসকে ঘিরে গেল ৪৮ বছর দেশের মানুষের উন্নত জীবন-যাপনের চেষ্টা চলছে হয়তো কেউ কেউ বলে বেড়ান দেশের কাক্সিক্ষত পর্যায়ের অগ্রগতি হচ্ছে না। বলার কিছু সুনির্দ্রষ্টি কারণ তো আছেই। যেমন স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও দেশের ২য় প্রধান শহর চট্টগ্রামে হলো না স্মৃতিসৌধ। কর্মসংস্থান নিয়ে আছে চরম হতাশা।
একটিতথ্য ৩৮তম বিসিএস এর প্রিলিমারি পরীক্ষার পরীক্ষা দিয়েছেন ৩ লাখ ৪৭ হাজার পরীক্ষার্থী। মোট পদের সংখ্যা মাত্র ২ হাজার ২৪টি। প্রতি পদের বিপরীতে পরিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭১ জন। সমন্বিতভাবে সোনালী ব্যাংকে ৫২৭টি, বাংলাদেশ ডেভোলপমেন্ট ব্যাংকে ৩৯টি, কৃষি ব্যাংকে ৩৫১টি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে ২৩১টি, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনে ১টি এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনের ৭০টি সহ মোট ১ হাজার ৬৬৩ টি সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষা হয়। শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করছি ছিল অনার্স, মাস্টার্স।
এসব পদে অনলাইনে আবেদন করেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৬৭০ জন চাকরিপ্রার্থী। প্রতি পদের বিপরীতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯৬ জন। অনেক উন্নত দেশের মোট জনসংখ্যা আমাদের দেশের এই চাকরি প্রার্থীর সংখ্যার থেকে কম। একটি চাকরি পাওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা। পরিসংখাটি বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের অবস্থা। সবাই সার্টিফিকেটধারী বিএ, এমএপাস। কিন্তু পুথিঁগত বিদ্যা ছাড়া এদের কোন বিষয়ে কারিগরি শিক্ষায় কোন সুর্নিদ্রিষ্ট বিষয় ডিপ্লোমা জ্ঞান নাই। আর প্রতি বছরই এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান ধরন অনুযায়ী এই সমস্যা অদূর ভবিষ্যতে আরো জটিলতর হবে।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (আইইউ) তথ্য মতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১শ জন ¯œাতক ডিগ্রিধারী তরুণ তরুণীর মধ্যে ৪৭ জন বেকার। ভারত ও পাকিস্তানে প্রতি ১০ জন শিক্ষিত তরুণের তিনজন বেকার। ২০টি সর্বাধিক বেকারত্বেও দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বাদশ। অন্য এক তথ্যে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ শিক্ষিত বেকার যুক্ত হচ্ছে অর্থনীতিতে। এরা সবাই উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) বা সমমানের শিক্ষায় শিক্ষিত। বর্তমান চাকরির বাজারে যোগ্যতা ও দক্ষতা খুবই কম। সনদ অনুযায়ী চাকরি মিলছে না। চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় কর্মসংস্থানের এই হাল। প্রতি বছর উচ্চ শিক্ষা নিয়ে শ্রম বাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না।
আইএলও প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বের হার বাংলাদেশেই বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সাল থকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বেকারত্বেও হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
প্রায় এককোটি অশিক্ষিত, অদক্ষ, অর্ধশিক্ষিত শ্রমিক বিদেশে শ্রম বিক্রি করে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে। দেশের লাখ লাখ শিক্ষিত যুবক চাকুরীর জন্য হণ্যে হয়ে ঘুরেও কর্ম পাচ্ছেনা। এর বিপরীতে দেশের রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস শিল্পসহ ম্যানুফেকচারিং ও সেবাখাতে বেশ কয়েক লাখ বিদেশি শ্রমিক আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত রেমিটেন্সের প্রায় অর্ধেক নিয়ে যাচ্ছে। যেন তেনভাবে দেওয়া আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানসম্পন্ন যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ জনবল গড়ে তোলা দূরে থাক দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের যোগান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
শিক্ষা মানুষের সব দৈন্যদশা, অভাব-অনটন থেকে মুক্ত করার কথা, অথচ আমাদের দিন দিন দৈন্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সমস্যা-সম্ভাবনা বিচার-বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণালব্ধ মানবসম্পদ উন্নয়নের ডিপ্লোমা শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়নি, এই নিয়ে আমাদের কিছু সুনির্দ্রষ্টি প্রস্তাবনা ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরে জমা দেয়া আছে।
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে ভারতে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে ব্রিটিশরা প্রথমেই হিন্দু-মুসলমান ট্রাডিশনাল শিক্ষাব্যবস্থায় আঘাত করে। মোঘলরা সংস্কৃত-ফার্সি ভাষায় লিখিত হিন্দু ও মুসলমনাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য, গ্রীক ও পারস্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে কর্মক্ষম করার শিক্ষা চালু করেছিল। ব্রিটিশরা সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়োগকৃত শিক্ষাবিদ রাজনীতিক টমাস বেবিংটন ম্যাকলে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার প্রভাবের পাশাপাশি শিক্ষাকে সার্টিফিকেট নির্ভর করে তোলার প্রস্তাব পেশ করেন। তাঁর প্রস্তাব অনুসারে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮৩৫ সালের শিক্ষা আইন পাস করে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে কর্মের হাতছানি দেওয়া ডিপ্লোমা প্রযুক্তি শিক্ষাকে দ্বিধাবিভক্ত করে।
ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল এ দেশে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, যেখান থেকে কিছু ইংরেজি জানা লোকবল বেরিয়ে আসবে, যাদেরকে ইংরেজরা প্রশাসনে পিয়ন-চাপরাশি, কেরানি বা হিসাব রক্ষক পদে কাজ করানো যায়। সেইলক্ষ্যে তারা শতভাগ সফল হয়। সার্টিফিকেট বিক্রির বাণিজ্য এখন আমাদের এক নম্বর ব্যবসা। গুরুত্বপূর্ণ ডিপ্লোমা শিক্ষাতে মনোনিবেশ লোক দেখানো। যে কোন শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে বোর্ড কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে হাস্যকরভাবে তা ফ্যাকাল্ট্রি, কাউন্সিল, অনুষদ, একাডেমি বিচ্ছিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আদর্শহীন এই সব প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক গোঁজামিল, অপচয়, দুর্নীতি ডিপ্লোমা শিক্ষাকে লেজে গোবরে করে রেখেছে। এ কারণে অভিজাত, মেধাবীরা ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় না। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের এই সার্টিফিকেট প্রদর্শন করে দেশে কিংবা বিদেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না।
মেধাবীরা বঞ্চিত হওয়ায় পুরো ডিপ্লোমা শিক্ষাব্যবস্থাই এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দেশের ডিপ্লোমা শিক্ষাব্যবস্থাকে এ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে না পারলে আমাদের সব সম্ভাবনা ও সামাজিক-রাজনৈতিক প্রত্যাশা ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হবে। আমাদের প্রয়োজন পণ্য ও পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষিত ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হলে বিদেশেও চাকরির সুযোগ নেই। ইংরেজদের দুইশ বছরের ঔপনিবেশিকতার যুগ পেরিয়ে গত ৭০ বছরে উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে আরো দুইবার বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হওয়ার পর ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুর্নিদ্রিষ্ট নীতিমালা করা হয় নাই। প্রতিষ্ঠা করা হয় নাই কোন বোর্ড আমরা এখনো কাউন্সিল একাডেমি নির্ভর।
আমাদের যেমন নতুন সরকার বিপুল জনসমর্থন নিয়ে নতুনভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে তেমনি কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে ডিপ্লোমা শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন শপথে বলীয়ান হতে হবে। ডিপ্লোমা শিক্ষাকে ঢেলে সাজিয়ে শ্রমশক্তির আওতায় আনতে হবে তরুণদের। অত্যাচার-নিপীড়নে জর্জরিত বাঙালি জাতির সামনে আলোকময় ভবিষ্যতের দুয়ার খোলার অকৃত্রিম প্রয়াস যেমন আমাদের স্বাধীনতা। তেমনি গৌরব ও অহঙ্কারের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে প্রগতি, কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হবে। আর তা সম্ভব তরুণদের কাক্সিক্ষত কর্মের প্রতিফলনে।