আমাদের রোগবালাই চিকিৎসা পদ্ধতি ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ভাবনা

61

অসুস্থ ব্যক্তিকে ঘরের বাইরে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করাকে সেবার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। পণ্য হিসেবে নয়, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যসেবা একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে, যা পরিণত হয়েছে সেবা না হয়ে শোষনের পণ্যে এই মর্মে আমরা ভুরিভুরি অভিযোগ পাই। অহেতুক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে রোগীদের আর্থিকভাবে হয়রানি করার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। চিকিৎসা চালানো প্রায়ই ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিষেধক অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম কথাটি আমাদের চিকিৎসকরা যেন প্রায় ভুলেই গেছে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটা কোনো সুস্থ বিনিয়োগ নয়। আর্ত মানবতার সেবায় জীবন করেছেন-এমন চিকিৎসকের উদাহরণ আমাদের দেশে কম নেই। কিন্তু পাশাপাশি আরেক দল চিকিৎসকের প্রসঙ্গ উঠলে তাদের নামের পাশে অনেক নেতিবাচক বিশ্লেষণ যোগ করা হয়। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে যে সুষ্ঠু বিনিয়োগ হয় না সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশে হাসপাতাল নির্মাণের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। অথচ সেই হাসপাতালে না আছে পর্যাপ্ত ডাক্তার, না আছে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসামগ্রী। মোট কথা আমাদের জাতীয় দিকনির্দেশনায় যুগোপযোগী স্বাস্থ্য পরিকল্পনার অভাব প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ প্রায়ই রূপ নেয় অপচয়ে।
আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি জোর দয়া হয় অ্যালোপ্যাথিক পদ্ধতির চিকিৎসার ওপর। যা অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায়, সবচেয়ে ব্যয়বহুল। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বেসরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ হেলথওয়াচ’ এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭৫ শতাংশ মানুষই স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তা ছাড়া বাজেট ব্যয়ে দুর্নীতি, অবস্থাপনা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব স্বাস্থ্যসেবাকে দিন দিন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।
চিকিৎসা প্রসঙ্গ এনে আমরা সবসময় নিরাময়যোগ্য (কিউরেটিভ) প্রতিষেধক নিয়ে কথা বলি, প্রতিরোধমূলক (প্রিভেনটিভ) ব্যবস্থা নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয় না। শুধু উপদেশ বা কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দিয়ে যে অনেককে বহু জটিল ও কঠিন রোগ থেকে বাঁচাতে পারি। সে কথা খুব কমই ভেবে থাকি। হিসাব করে দেখা গেছে, রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগের প্রতিরোধ শতকরা ২০০ ভাগ বেশি সাশ্রয়ী। কারো য²া হলে তার চিকিৎসা করা হয়; কিন্তু তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের যাতে এই রোগ না হয়, সেই ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আমরা সহজেই এমন হাসপাতালের কথা ভাবতে পারি যেখানে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার ওপর জোর দেয়া হবে। যে এলাকায় যে রোগের প্রকোপ বেশি। সে এলাকায় সে ধরনের প্রতিরোধমূলক হাসপাতাল স্থাপন করা গেলে সংশ্লিষ্ট রোগের প্রকোপ কমে আসবে। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় আরো যে বিষয়টির অভাব তা হলো হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ বা সার্বিক চিকিৎসাব্যবস্থা। যেমন কেউ য²ায় আক্রান্ত হলে তার রিবার ও প্রতিবেশিরা যেন এই রোগে আক্রান্ত না হয়, সে ধরনের ফলোআপ চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ।
স্বাস্থ্যসেবা অধিক সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আরেকটি বিষয় বিবেচনা করা যায় আমাদের দেশের সরকার মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রায় বিনাখরচে শিক্ষা নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। আমাদের এসব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দেশে ও সমাজ কী পাচ্ছে, তা ভেবে দেখা দরকার। গরিব মানুষের করের পয়সায় ডাক্তার হয়ে তাদের খুব কমজনই সেই দরিদ্র মানুষগুলোর সেবায় সময় ব্যয় করেন। আমরা কি এমন হাসপাতালের কথা চিন্তা করতে পারি যেখানে আমাদের মেডিকেল কলেজগুলো থেকে পড়াশোনা শেষ করে সনদ নিয়ে যারা বের হন, তারা এখানে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেবেন। বিষয়টি এমন হবে যে, কেউ চিকিৎসক হয়ে বের হওয়ার পর কিছু দিন তাকে সমাজসেবা করতে হবে এবং এটা হবে বাধ্যতামূলক। সরকারি ভর্তুকি দিয়ে শিক্ষা গ্রহণের ফলে তাদের যে সামাজিক তৈরি হয়েছে, তার কিছুটা কমানোর প্রক্রিয়া হিসেবেও একে দেখা যেতে পারে। ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেক নবীন ও প্রবীণ চিকিৎসক এখানে সেবা দিয়ে যাবেন। আমরা জানতে পেরেছি পাশ্চাত্যের অনেক দেশে কেউ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চাইলে তাকে কোনো হাসপাতালে গিয়ে কয়েক ঘন্টা রোগী সেবার পেছনে ব্যয় করতে হয়। এটা তার বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে যোগ হয়ে থাকে আবার শিক্ষাগ্রহণ শেষে ইন্টার্নশিপ বা এ ধরনের সোস্যাল সার্ভিসের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এর জন্য মটিভেশনের প্রয়োজন। মটিডেট বা উদ্বদ্ধ করা গেলে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যিনি প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে জনকল্যাণে সময় ব্যয় করতে রাজি হবেন না। দুঃখজনক হলো আমরা বিনিয়োগ করছি নিছক বস্তগত সুবিধা হাসিলের জন্য, রোগীর মানসিকতার দিকটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আরেকটি বিষয় চরম উপেক্ষিত বলা চলে। তা হলো প্রচলিত বা দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতি যাকে বলে ‘কমপ্রিমেন্টারি অ্যান্ড অন্টারনেটিভ মেডিসিন’। এই পদ্ধতি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড অল্টারনেটিভ মেডিসেন একটি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে গবেষক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। নানা রকম ভেষজ ওষুধ, যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, আকুপাংচার, ফি মিউজিক থেরাপিসহ বিভিন্ন কমপ্লিমেন্টারি পদ্ধতিই এখন রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহের বিষয় ও শেষ ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের নিজস্ব জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান, খাদ্যাভ্যাস, শরীর ও মনের স্বাভাবিক বিন্যাস এবং সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা পদ্ধতির সমন্বয় সাধন এই চিকিৎসার বৈশিষ্ট্য, নিউইয়র্কে এ ধরনের একট কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার মিচেল গেইনার এই পদ্ধতির সমন্বয় সাধন এই চিকিৎসার বৈশিষ্ট্য। নিউইয়র্কে এ ধরনের একটি কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার মিচেল গেইনার ্ই পদ্ধতিকে বলেছেন, সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এক বিস্ময়কর উপকার। জীবনের অনেক নিগূঢ় রহস্য রয়েছে, মেডিকেল ল্যাবরেটরি চৌহদ্দিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মেডিকেল কলেজে এই ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিনের কোর্স চালু করেছে। অন্টারনেটিভ মেডিসের বহু পদ্ধতি শত শত বছর ধরে আমাদের সমাজে চালু রয়েছে। ভেষজ, ইউনানি, মেকিমি, কবিরাজি বা আয়ুবেদিক ইত্যাদি চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি আমরা যথাযথ দৃষ্টি দিতে পারিনি।
স্বল্পব্যয়ের আরেকটি কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি হচ্ছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাপদ্ধতি। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না এটি পাশ্চাত্যজগতের একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। জার্মানির মত প্রযুক্তির জন্য খ্যাতিমান দেশও চিকিৎসার জন্য এই পদ্ধতির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করছে। অথচ আমাদের বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতিতে বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। এসব চিকিৎসাপদ্ধতি ও ওষুধগুলো আরও আধুনিক করার তেমন কোনো প্রচেষ্টা আমাদের নেই। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার ওপর জোর দিতে গিয়ে আমাদের দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির মতো অমূল্য সম্পদ ও জ্ঞান বিলুপ্ত হতে চলেছে। আমরা ভেষজ চিকিৎসার উন্নয়ন ও গবেষণায় বিনিয়োগ ও মনোযোগ দিচ্ছিনা বললেই চলে। এই চিকিৎসা ক্ষেত্রে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আগমনকে উৎসাহিত করার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা আমাদের নেই। সরকার এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে কিছু অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন তেমন দেখা যায় না। জাতীয় বাজেটে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার ভগ্নাংশও দেশীয় বা হোমিও চিকিৎসার জন্য দেয়া হয় না। এমন অনেক রোগ আছে যার চিকিৎসায় অ্যালোপ্যাথির তুলনায় হোমিও বা ভেষজ পদ্ধতিতে অনেক কম খরচে বেশি সুফল পাওয়া যায়। আমরা সংশ্লিষ্ট মহল থেকে জেনেছি, অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের ৪০ শতাংশই ভেষজনির্ভর। তাই রোগ বালাই এ ভেষজ ও অন্যান্য দেশীয় চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করা গেলে জনগণকে অনেক সস্তায় চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব। কিন্তু আমরা সস্তায় চিকিৎসাসেবা দেয়ার কথা ভাবিনা। আমরা হাসপাতাল তৈরি করছি। রোগী আসবে এই আশায়। হাসপাতাল স্থাপনের আগে আমরা ভাবি। যত বেশি রোগী তত বেশি লাভ বা ব্যবসার প্রসার। আমরা কখনো চিকিৎসা দেয়া হবে যেন রোগীর আসা ক্রমেই বন্ধ হয়ে যায়। আমরা কি কখনো এমন হাসপাতাল তৈরির কথা ভেবেছি সেখানে রোগীর ভিড় বৃদ্ধি না পেয়ে কেবল কমতে থাকবে? সম্ভবত কেউ ভাবিনি। অথচ এই ভাবনাই একটি সুস্থ জাতি গঠনের দিকনির্দেশ বা সহায়ক হতে পারত। এই ভাবনা সমাজের সার্বিক উন্নয়নের আলোকবর্তিকা হতে পারে।
পাদটিকা : একটি নুতন হাসপাতাল খোলার সময় একজন মৌলবি সাহেবকে দোয়া করতে বলা হলো অবশ্য টাকার বিনিময়ে। এবার মৌলবি সাহেব এরূপ মোনাজাত করলেনÑ দোয়ার মাধ্যমে, ‘হে আল্লাহ এ এলাকার ও আশে পাশের লোকদের যাতে বেশি বেশি রোগ হয় ও সেই রোগ সারানোর জন্য এই হাসপাতালে আসতে হয় এবং তাতে হাসপাতালের প্রচুর আয় হয় এই দোয়া করছি। বলাবাহুল্য উপস্থিত জনগণ মৌলবি সাহেবের এই ধরনের দোয়ার প্রবল প্রতিবাদ করেছিলেন। এই পাদটিকার মাধ্যমেই আজকের লেখাটির ইতি টানলাম।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট