‘আমাকে এভাবে কেউ কখনও বলেনি’

88

আমার ও তার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। আমাকে তিনি ‘তুই’ সম্বোধনও করতেন। এই তো সেদিন বুলবুল ভাইয়ের (আহমেদ ইমতিয়াজ) বুকে রিং পরানো হবে, তিনি আমারে বললেন, ‘তোরে আমি নিয়ে যাবো। তোর যেতেই হবে।’ এভাবে কেউ আমাকে বলেনি কখনও। এই যে অধিকার, আস্থা- তা নির্ভেজাল। তবে শুধু ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার বিষয় নয়। তিনি আমাদের দেশের সংগীতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দেশের গান, চলচ্চিত্রের গান, অ্যালবাম দিয়ে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তা ভোলার নয়। তার লেখনীতে যে কী ধার, যারা এটি গেয়েছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন।

ক্ষুরধার এই লেখনী বা ক্ষণজন্মা মানুষের আর রিপ্লেসমেন্ট হবে না। আমি বলবো, একটা মহীরুহের বিদায় এটা। দেশ স্বাধীনের পর টানা আট বছর তিনি শুধু দেশের গান লিখেছেন। মানুষ কিন্তু ভালোভাবেই জানেন, দেশের গানের স্পন্সর পাওয়া যায় না, বাণিজ্যিকভাবে লোকসান হয়। তারপরও দেশের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে এভাবে বছরের পর বছর শুধু দেশের গান করা যায়! আমি নিজ হাতে তার মরদেহটা ধরলাম!
মৃত্যু শাশ্বত, জানি। কিন্তু এমনভাবে, এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারি না। ভালো থাকুক আমাদের পাওয়ার লাইট, আমাদের আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

‘আমার গরুর গাড়িতে’ গানটি বুলবুলকে কালজয়ী করেছে : ইলিয়াস কাঞ্চন

ভক্ত-অনুরাগীদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন কিংবদন্তি সংগীত পুরুষ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার প্রয়াণে সংস্কৃতি অঙ্গনে বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। মৃত্যুর খবর পেয়ে কেউ কেউ ছুটে গিয়েছেন তার বাসায়। কেউ নিজ গৃহে বসেই করছেন স্মৃতিচারণ, নিজে নিজে আনমনে। অনেকে লিখছেন ফেসবুকে।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মৃত্যুর শোক ছুঁয়ে গেছে আশি-নব্বই দশকের সুপারস্টার ইলিয়াস কাঞ্চনকে। জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘এই চলে যাওয়া নিয়ে কোনো কথাই আসলে ভাবতে পারছি না। বুলবুল আমার বন্ধু, আমি বুলবুলের বন্ধু। আমরা সমবয়সী ছিলাম। অনেক ভালো সময় কেটেছে আমাদের।’ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘একটি দুটি নয়। অনেক জনপ্রিয় গান ও করেছে যেগুলোতে আমি নায়ক ছিলাম। তার মধ্যে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের লেখা, সুর ও সংগীতে ‘আঁখি মিলন’ ছবির ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ গানটি ম্যাসিভ সুপারহিট। সুচরিতা আর আমি জুটি ছিলাম এই গানে। শিল্পী ছিলেন এন্ড্রু কিশোর ও সাবিনা ইয়াসমিন।

গানটি প্রচুর রিমেক হয়েছে পরবর্তীতে দেশে-বিদেশে। ওপার বাংলাতেও খুব হিট এই গানটি। আজও শিল্পীরা মঞ্চে উঠলে বা বিয়ে বাড়িতে এই গান গেয়ে থাকেন। অনেকেই গানটি রিমেক করে তারকাও হয়েছে। আমি মনে করি এই গানটি বুলবুলকে কালজয়ী করেছে, সিনেমাটিকেও কালজয়ী করেছে। আমার ক্যারিয়ারে অনবদ্য একটি সংযোজন গানটি।’

মৃত্যুতে যা বললেন চিকিৎসক

অনেক দিন ধরেই হার্টের অসুখে ভুগছিলেন কিংবদন্তি সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। অবশেষে হার্ট অ্যাটাকেই জীবনের অবসান ঘটলো তার। এই শিল্পীর ব্যক্তিগত সহকারী রোজেন বলেন, “স্যার ভোর সোয়া ৪টার দিকে বাসায়ই মারা গেছেন। তিনি নিজেই আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘তাড়াতাড়ি বাসায় আস, আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।’ এরপর ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আমি স্যারের বাসায় যাই। কিন্তু কোনো পালস পাইনি। পরে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা তাকে সাড়ে ৫টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন। স্যারের সাথে কোনো কথাই বলার সুযোগ পাইনি আমি।” এদিকে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ চক্রবর্তী গণমাধ্যমকে জানান, হার্ট অ্যাটাক হয়েই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি বুলবুলের হার্টে আটটি বøক ধরা পড়ে। তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে পেরে চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর বুলবুলকে ভর্তি করা হয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। সেখানে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা বুলবুলের বাইপাস সার্জারি না করে শরীরে রিং পরানোর সিদ্ধান্ত নেন। এরপর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন তিনি। সে সময় রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. অধ্যাপক আফজালুর রহমানের অধীনেই বুলবুলের শরীরে দুটি স্টেন্ট (রিং) স্থাপন করা হয়।

পুরস্কারের দুই ছবির নায়কই রিয়াজ স্মৃতিচারণে চোখ ভেজালেন

সেই ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন সদ্য প্রয়াত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারে তিনি শত শত চলচ্চিত্রে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান।
কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ তিনি পেয়েছেন দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। মজার ব্যাপার হলো- ‘প্রেমের তাজমহল’ ও ‘হাজার বছর ধরে’ দুটি ছবিরই নায়ক রিয়াজ। তাই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের প্রয়াণে সারাদেশের সংগীত পিপাসু মানুষ যখন শোকে কাতর, এই চিত্রনায়ক যেন একটু বেশিই শোকাহত।
গুণী এই মানুষটিকে নিয়ে বলতে গিয়ে রিয়াজ বলেন, ‘এটা আমার সত্যি দারুণ এক সৌভাগ্য যে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো কিংবদন্তি যে দুটি ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন দুটি ছবিরই নায়ক আমি। এটা কাকতালীয়, এটা গর্ব করে বলার মতো একটি প্রাপ্তি। কারণ, এই দেশের সংগীতাঙ্গনে একজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের বিকল্প হয় না। গান লিখতে, সুর করতে ও সংগীত পরিচালনায় দুর্দান্ত ছিলেন তিনি। আপাদমস্তক একজন শিল্পী ছিলেন বুলবুল ভাই।’ এই চিত্রনায়ক স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘যখনই দেখা হতো চমৎকার একটা হাসি দিয়ে মুগ্ধ করে ফেলতেন। তার সঙ্গে মিশেছি ঘনিষ্ঠভাবে। আমি তাকে সবসময় শ্রদ্ধা করেছি। তিনিও আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমি জানি না কেন এমন হতো, যখনই তিনি আমার অভিনীত সিনেমার গান করতেন সেগুলো একটি বেশিই দরদ মেশানো থাকতো যেন! প্রকাশ হলেই দর্শক-শ্রোতা লুফে নিতেন।