আমরা যেমন বানিয়েছি সমাজ এখন তেমন হয়েছে, আমরা দায় অস্বীকার করতে পারিনা

130

আপনি যদি ভাল করে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, সারা বিশ্বের সব দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র ভেতরে বাইরে বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষ। বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতি। মানুষের যে নৈতিক চেতনা তা বিশ্বব্যাপী হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের দেশে ও আমরা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আমাদের এই প্রজন্মের মানুষ আগের দিনের মানুষের মতো নয়। রুচি ও মুল্যবোধ বদলে গেছে। আমরা বলি, আমাদের তরুণ তরুণীদের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব পড়েছে। বিশ্বায়ন আসলে কি? বিশ্বায়নে কর্তৃত্ব করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুসারী উন্নত দেশগুলি। তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব এবং জৈব প্রযুক্তির বিপ্লব আমাদের প্রচলিত ধ্যান ধারনা বদলে দিচ্ছে।
আপনি লক্ষ্য করে দেখলে বুঝতে পারবেন, এখন মানুষের মনে প্রত্যাশা অনেক বেশী। রাস্তায় যানজটে আটকা পড়া মানুষ ভাবে, যানজট হচ্ছে- এটা কি সরকারের ব্যর্থতা? বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট হয়, এটা কি সরকারের ব্যর্থতা? এসএসসি বা এইচএসসিতে পাশের হার কমেছে- এটাও কি সরকারের ব্যর্থতা? ধানের দাম কমে গেছে, এটাও কি সরকারের ব্যর্থতা? চালের দাম বেড়েছে এটাও সরকারের ব্যর্থতা? মাদক সেবন হচ্ছে- সরকারের দোষে, এটা হচ্ছে? ধর্ষণ, চাপাতি দিয়ে কোপানোর ঘটনা ঘটছে, বা আগুন লাগছে, এসবই সরকারের ব্যর্থতা? গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা নিয়েও মানুষের হতাশা আছে। এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে একই রকম ঘটনা ঘটছে। সব কিছুতে সরকারকে দায়ী করা হয় কেন? সব দোষ সরকারের হতে যাবে কেন? কিন্তু দায় সরকারের কাঁধে দেয়া হয়। যা যা মানুষের খারাপ লাগে- সব সরকারের দোষ? বিশ্ব এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। সারা বিশ্বের অর্ধেক মানুষ মনে করে যে, তাদের সরকারগুলি কাজে কর্মে অগণতান্ত্রিক। সরকারের সাথে জনগনের সম্পর্ক নিয়ে নানা রকম জরীপ হয়েছে। জার্মান জরীপ প্রতিষ্ঠান ডালিয়া রিসার্চ সম্প্রতি একটি জরীপ পরিচালনা করেছে, যা গুরুত্বপুর্ণ অবজারভেশন আমাদের দিয়েছে। জরীপে সাহায্য করেছে, এলায়েন্স অফ ডেমোক্রেসিস ফাউন্ডেশন এবং রাসমুর্সেন গ্লোবাল। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করুন। এক একটি দেশের বাছাই করা মানুষকে প্রশ্ন করা হয়েছে, আপনার সরকারের প্রতি আপনার দেশের মানুষের আস্থা কেমন? আপনার দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা কি? আপনার দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু আছে? গণতন্ত্রের সুফল প্রাপ্তির ব্যাপারে জনগনের মনোভাব কি? গণতান্ত্রিক ভাবে খোলামেলা নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসা নেতা এবং স্বৈরশাসকের মধ্যে পার্থক্য কি?
এসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন, বুদ্ধিজীবীরা। আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবীগণ রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। অনেক বুদ্ধিজীবী আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন। কেউ কেউ বিএনপি সমর্থন করেন। বুদ্ধিজীবীগণের নিজ নিজ মতাদর্শ থাকতে পারে। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের উচিৎ জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং জনগণের জীবনেরসমস্যা নিয়ে কথা বলা। প্রয়োজনে প্রতিবাদী হওয়া। জনগণের সমস্যার সমাধান জনগণই বলে দিতে পারেন এটা বোঝেন বুদ্ধিজীবীরা। জনগণের সমস্যা নিয়ে মতামত দিচ্ছেন না, বুদ্ধিজীবীরা। এটা ভাল লক্ষণ নয়। আমি মনে করি, সংবাদ পত্রে সাংবাদিকরা জনগণের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন। লেখকরা লিখছেন। টিভি চ্যানেলে ও কথাবার্তা হচ্ছে। যারা উন্নতি আশা করেন, তাদের বুঝতে হবে, জনগনের “কন্ঠস্বর” উন্নয়ন বিরোধী কিছু নয়। আমরা শুধু বলার জন্য বলিনা, লিখার জন্য লিখিনা, চিন্তার জন্য চিন্তা করিনা, আমরা ভীত নই, পান করার জন্য তৃষ্ণার্ত নই, খাওয়া দরকার- তেমন ক্ষুধার্ত নই, শুধু চিন্তার জন্য চিন্তা দিয়ে হবেনা, কাজের জন্য চিন্তা করতে হবে, কাজ করার জন্য উন্নত চিন্তা করতে হবে, দেশকে বদলানোর জন্য উন্নততর চিন্তা করতে হবে। স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে হবে। বুদ্ধিজীবীগণ সামনে তাকাবেন, একে বলে, লুক এ হেড।
আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি। গণতন্ত্রকে বোঝার চেষ্টা করিনা। কেবল প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা ও তাকে পরাজিত রেখে ক্ষমতায় থাকা- এটা রাজনীতি নয়। সব দল চেষ্টা করতে পারে নিজেদের রাজনীতি যেন উন্নত করা যায়। বামপন্থী দলগুলি এখন যে রকম আছে- সেরকমই থাকবে? মানুষের জন্য ভাববে কে? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের অনুক‚ল শিক্ষা ব্যবস্থা? এতে তো অতি আত্মকেন্দ্রিক মানুষ তৈরী হচ্ছে। আমি যে তিন দশক শিক্ষকতা করেছি, আমি কি করেছি? মনে হয়, বড় লোকের ছেলে মেয়ের জন্য কাজ করেছি। শিক্ষা আরো গরীবমুখী হতে হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি ধরি, তাহলে বুঝতে হবে, শিক্ষার অনেক যায়গাতে গরীবের একসেস নাই। আমি শিক্ষক হিসেবে আত্মকেন্দ্রিক মানুষ তৈরী করেছি। ছাত্রদের ভেতরে উচ্চাভিলাষ ঢুকিয়েছি। ব্যক্তিগত ভাগ্য উন্নয়নে মরিয়া এমন মানুষ তৈরী করেছি। আমাদের কাছে শিক্ষা পাওয়া ছেলে মেয়ের মনে ও চিন্তায় রাষ্ট্র নেই। জাতি নেই। সামষ্টিক স্বার্থ নেই। দারিদ্রের হাহাকার বোঝার শক্তি নেই। অনেকাংশে আছে নিজের উন্নয়ন চিন্তা। আমি তাকে কোলে নিয়েছি, তাকে ‘অক্ষর’ শিখিয়েছি, সে এখন কোটিপতি হয়েছে, এমপি হয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে, কর্পোরেট জগতের নির্বাহী হয়েছে- সে আমাকে দেখলে ভাল করে চিনতে পারেনা। বড় ভাই তাকে, নিজে না খেয়ে খাইয়েছে- এখন সে ছোট ভাই বড় লোক হয়ে বড় ভাইকে দমন করছে- এসবের জন্য আমি দায়ী। আমরা যেমন শিক্ষা দিয়েছি, সমাজ এখন তেমন হয়েছে। আমরা আমাদের দায় অস্বীকার করতে পারিনা।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে তার বক্তব্যের জন্য আমাদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিনি দেশ চালাবেন শিখে শিখে। মানুষের সম্মতি নিয়ে এবং সেবকের মনোভাব নিয়ে। কথা অতি সাধারণ। কিন্তু জনগণ এটা আশা করে। জেলেনস্কির মতো এরকম করে কথা বলা সম্ভব নয় অনুন্নত গণতন্ত্রে। জনগণ ভোট দিয়ে যখন প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন, তারা এরকম নেতাই চাইবেন। জেলনস্কি ছিলেন কমেডিয়ান। ‘সার্ভেন্ট অফ দ্যা পিপল’ নামক কমেডিতে তিনি স্কুল শিক্ষক থেকে ঘটনা ক্রমে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া একটি ভুমিকায় সরস অভিনয় করে নাম করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহনের পর ২০ মে প্রথম ভাষনে তিনি সরকারী দপ্তরে তার ছবি না রাখার অনুরোধ জানান। কারণ, তার ভাষায়, প্রেসিডেন্ট কোন আইকন নন, কোন আইডল নন, বরং তারা তাদের সন্তানদের ছবি অফিসে ঝুলিয়ে রাখুক। তিনি বলতেন, মানুষ একটি “মানবীয় মুখ” চায় তাদের প্রতিনিধি হিসাবে। আমাদের শাসকদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ শাসন করা নয়, কর্তৃত্ব করা নয়, করের বোঝা চাপানো নয়, কি করা? মানুষের সেবা করা। মানুষকে সাহায্য করা। মানুষকে সুখী করা। মানুষের মন থেকে আঘাতের দাগ মুছে দেয়া। কিন্তু আমাদের দেশে উপজেলা পর্যায়ের, জেলা পর্যায়ের নির্বাহীদের যে দাপট তাতে আমরা মন্ত্রী এমপিদের, ডিসি এসপিদের সেবক ভাবতে ভুলে গেছি। মুখে সেবক বলি। মনের গভীরে সে বোধ রাখিনা।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ,
অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ