আমরা বদলের অপেক্ষায় আছি

69

এক.
আমরা অসুস্থ লোককে রোগী বলি। অসুস্থতা বলতে সাধারণত আমরা শরীরের অসুখ বুঝি। পেটের অসুখ, মাথাব্যাথা, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার বেড়ে হাইপার টেনশন, ক্যান্সার, রক্তশূন্যতা এরকম নানা রোগ নিয়ে রোগী ডাক্তারের কাছে যান। অনেকে মানসিক রোগে ভোগে। তারা ও রোগী। তাদের জন্য আছেন মানসিক রোগের ডাক্তার। যখন মানুষের “চেতনা” বিকৃত হয়, তখন আমরা সেটাকে রোগ বলে গণাক্ত করতে পারিনা। যখন মুল্যবোধ বিকৃত হয়, তাকেও আমরা রোগ বলে চিহ্নিত করতে পারিনা। কিন্তু মানুষের চেতনা, ও আত্মা সমৃদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে- ক্ষয়িষ্ণু হওয়ার প্রবনতা দেখা দিতে পারে। যে লোক টাকাতে বেচা যায়, তাকে কোন রোগের রোগী বলবেন? যে লোক আপনার কাছ থেকে খেয়ে পরে, আপনাকে মারতে আসে,আপনার দ্বারা ব্যাপক ভাবে উপকৃত হয়ে আপনাকে মারতে আসে, তাকে কোন্ রোগের রোগী বলবেন? যে লোক রং বদলায়, আজকে এর পদলেহন করে, কাল ওর পদলেহন করে, তাকে কোন্ রোগের রোগী বলবেন? আত্মা অসুস্থ হলে মানুষ অসুস্থ হয়। সে রোগের চিকিৎসা উদ্ভাবন করা দরকার। আমাদের আত্মা গুরুতর ভাবে অসুস্থ হতে পারে। অসুস্থ আত্মা, অসুস্থ জাতির লক্ষন। বিকৃত মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ বিপজ্জনক।
কোন লোক আমার কাছে এলো, বলল, আমাকে সাহায্য করেন, আমার ছেলেকে আপনার কলেজে ভর্তি করে দিন। অন্য এক তরুণ বলল, আমার এক আত্মীয়ের চাকুরী দরকার। আপনি সুপারিশ করলে কর্তৃপক্ষ শুনবে। আপনার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে কর্তৃপক্ষকে বলুন, চাকুরীটা দেয়ার জন্য। আচ্ছা, আমি নিজে দক্ষতা ভিত্তিক ব্যতিত তদবিরের মাধ্যমে সুপারিশ করার বিরোধী। আমি চাইনা ছাত্রছাত্রী তদবিরের মাধ্যমে স্কুল কলেজে ভর্তি হোক। আমি কেন সুপারিশ করব ? সে লোক বলল, আপনাকে আমি আমার আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথি করব। আপনাকে সংবর্ধিত করব। আপনাকে রাস্ট্রীয় পুরস্কার পাইয়ে দেয়ার জন্য শোরগোল করব। আপনি আমার লোকটাকে চাকুরী পাইয়ে দিন। আমি বুঝি, এসব সুপারিশ ঠিক নয়। অনেক দালাল ও মধ্যস্বত্ব ভোগী লোক,তারা সহজ সরল চাকুরী প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়। নিয়ে এর পেছনে ওর পেছনে ঘোরাঘুরি করে। তাঁদের ফাঁদে পা দিব আমি? কখনো না।নিয়মের বাইরে যাবনা। টাউট বাটপারের কথা না শুনলে সে আপনার পেছনে লাগবে। আত্মার জোর থাকলে টাউট বাটপার আপনাকে কিছু করতে পারবেনা। কেবল ঘেউ ঘেউ করবে। টাউট বাটপারকে প্রশ্রয় দিতে নাই। বাটপাররা আমাদের পেছনে লেগেণ আছে। এদের ক্লান্তি নাই। টাউটদের কথা না শুনলে পরিণতি কি হবে? সে আমার পেছনে লাগবে। চরিত্র হনন করবে। হুমকি ধামকি দেবে। আমার তো আত্মার অসুখ হয়নি। আমার ভুল ত্রæটি হতে পারে। কিন্তু আমি জেনেশুনে খারাপ লোকের ফাঁদে পা দিব কেন? আত্মার অসুখে আক্রান্তরা বেপরোয়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাল মানুষকে কলংকিত করার জন্য কলংকলেপন করছে। শিক্ষক ছাত্রীকে রেপ করছে। হুজুর বালককে বলাৎকার করছে। খোলা রাস্তায় চাপাতি দিয়ে মানুষকে কোপাচ্ছে। আত্মার অসুখ সমাজে ভয়াবহ বিপর্যয় আনতে পারে। আমাদের আত্মাকে ঘিরে ফেলেছে ভয়াবহ ভাইরাস। আমাদের সমাজ নৈতিকতা ও মূল্যবোধ হারাচ্ছে। টেলিভিশন প্রোগ্রাম আর দেখিনা। টিভি অন করলে টিভি পর্দা জুড়ে ধর্ষণের খবর। মনে মনে ভাবি আমাদের আত্মায় বাসা বেঁধেছে জটিল অসুখ। স্কুল, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম শিশুকে ধর্ষণ করছে। শরীরের অসুখ থেকে আপনি আরোগ্য লাভ করতে পারেন, মনের অসুখেরও চিকিৎসা আছে, আত্মার রোগ ভয়াবহ রোগ।আমাদের নৈতিকতা চর্চা করতে হবে। ন্যায়নীতির উপর গুরুত্ব দিতে হবে। নান্দনিক বোধের বিস্তার ঘটাতে হবে। শুদ্ধাচারে অভ্যস্ত হতে হবে। শুদ্ধতার উৎসগুলি কোথায় খোঁজ করবেন? সচেতনতা এত সহজ জিনিস নয় যে, আপনি চাইলেই সচেতন হতে পারবেন। যে লোক টাউট স্বভাবের, তার সচেতন হয়ে লাভ কি ? আত্মার অসুখ এত ব্যাপক যে, সে রাজনীতিকে অসুস্থ করে তোলে।
কেন অপরাধীরা ক্রমাগত বেপরোয়া হয়ে উঠছে? কেন অপরাধীরা ভাবছে যে, অপরাধ যত গুরুতর হবে, তত তাদের সুরক্ষা দিতে এগিয়ে আসবে শক্তিশালীরা? ধর্ষক জামিন পায়। আবারো ধর্ষণ করে। সোনাগাজীতে নির্যাতককে বাঁচাতে চেয়েছে পুলিশ। শিশুর জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ কি আমরা রচনা করতে চাই?
দুই.
আমার কাছে “গণতন্ত্র” একটি মহান শব্দ। আমি মনে করি রাজনীতিবিদদের উচিৎ গণতন্ত্রকে তাদের জীবনের মুলমন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করা। রাষ্ট্র শাসনের প্রশ্নে জনগনের রায়ই শেষ কথা হওয়া উচিৎ। গণতন্ত্র পদদলিত হওয়া মানে, মানুষের অধিকার ভুলুন্ঠিত হওয়া। গণতন্ত্র ভুলুন্ঠিত হওয়া মানে দেশবাসীর আত্মা “লাইফ সাপোর্টে” চলে যাওয়া। আত্মা অসুস্থ হলে রাষ্ট্র খাদে পড়ার দিকে ধাবিত হতে থাকে। আত্মাকে তরতাজা রাখার জন্য আমাদের সকলের নৈতিকতার মান বাড়াতে হবে। কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব আত্মাকে বিকশিত হতে দেয়না।
তিন.
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) একদা কর্তৃত্ববাদী শাসনের চাপে পিষ্ট হচ্ছিল, বলে মন্তব্য করতেন, পুঁজিবাদী দেশের বুদ্ধিজীবীরা। ১৯৮৯ সালে মস্কোর মহাসড়কে নেমে আসে লাখ লাখ রুশ গণতন্ত্রকামী। রুশরা ১৯৮৯ সালকে “মহান প্রত্যাশার বছর” বলে মনে করে। তখন রুশ ব্যান্ড দল গাইত “উই আর ওয়েটিং ফর চেঞ্জেস।” ওই ব্যান্ড দলের নাম “কিনো” কিনোর গান রুশ জনতা শুনত“আমরা পরিবর্তন চাই।” আমরা বদলের অপেক্ষায় আছি। সব বদলে দাও। এই গান শুনে রুশ জনতা হর্ষ ধ্বনি করত। কখনো কখনো বদলকামীদের উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে।
স্বৈরাচার অনৈতিকতা, কর্তৃত্ববাদী শাসনের চাপে যখন সমাজ পচে যায়, তখন সিস্টেম বদলের ব্যাপারটি গভীর ভাবে চিন্তা করতে হয়। কেবল শাসক বদল হলে সিস্টেম আপগ্রেড হয়না। গণতন্ত্র- মানুষের কাছে মুক্তির স্বাদ নিয়ে আসতে পারে।
চার.
ইরিনা শেরবাকোভা রুশ লেখক ও ইতিহাসবিদ। তিনি প্রিন্ট মিডিয়ার একজন নন্দিত লেখক। মানবাধিকার সংস্থা “মেমোরিয়ালের” প্রতিষ্ঠাতা। দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হরিনা শেরবাকোভার একটি লেখার অনুবাদ ছেপেছে দৈনিক প্রথম আলো (১১/৭/১৯)। ওই লেখায় শেরবাকোভা বলেছেন, রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালকে মহান প্রত্যাশার বছর বলা হয়। তিনি লিখেছেন, ওই সময়ে রাশিয়াতে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শুরুটা আমরা করতে পেরেছি। ওই সময়ে সংস্কারের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা আমাদের নতুন সরকার রাশিয়ার অতীত নির্যাতনের ইতিহাস কাজে লাগাতে পারবে। কিন্তু দেখা গেল আমাদের সংস্কারকেরা বাজার অর্থনীতি গড়তে যতটা আগ্রহী, ততটা ইতিহাস সংরক্ষনের বিষয়ে আগ্রহী নন। তারা অর্থনৈতিক সংস্কারের সংগে সরব এক শক্তিশালী সুশীল সমাজের যোগসূত্রের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারলেন না। তারপর রাশিয়া ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ল। তখন বহু রুশ নাগরিকের কাছে “গণতন্ত্র” একটি নোংরা শব্দ হিসাবে প্রতিভাত হলো। (কখনো কখনো মানুষের কাছে গণতন্ত্র নোংরা সিস্টেমে পরিণত হয়)। এটা গণতন্ত্রের দোষ নয়।
পাঁচ.
আমাদের দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। মানুষকে অনাহারে থাকতে হচ্ছেনা। ২০১৮ সালের হিসাবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.৬ শতাংশ। মাথাপিছু দারিদ্র্যের হার কমেছে। এখন এটা ২৪.৩ শতাংশ (বিবিএস ২০১৬)। পর নির্ভরশীলতার হার সবচাইতে কম। এর পাশাপাশি আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। অসম উন্নয়ন- একে এড্রেস করতে হবে। বেকারত্বের হার আরো কমাতে হবে। আয় বৈষম্য কমাতে হবে। বাংলাদেশে উন্নয়নের গতি প্রশংসিত হচ্ছে।
সমাজে টাউট বাটপাররা- রেন্ট সিকিং, মধ্যস্বত্ব ভোগের প্রবণতা, এবসেন্টি ইনকামভোগ করার প্রবণতাকে জোরদার করছে। সমাজ পচে গেলে “গণতন্ত্র” কিভাবে জোরদার হবে? আত্মার অসুখ নিরাময় করার জন্য বুদ্ধিজীবী সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। কথাবার্তা বলতে হবে। বাটপারদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে।

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ,
অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
ঊ-সধরষ: ভধুষঁষযড়য়ঁবথ৭@ুধযড়ড়.পড়স