আমজাদ হোসেনের উপন্যাস সমগ্রে মুক্তিযুদ্ধের কতকথা

415

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী আমজাদ হোসেন (১৯৪২-২০১৯) জীবনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক নিঃসঙ্গ শেরপা বটে। তবে নাট্যকার, গীতিকার, অভিনেতা এবং কথাশিল্পের ক্ষেত্রেও এক সফল রূপকার। পঞ্চাশের গোড়াতে ক্যামেরার পাশাপাশি কলমও ধরেছেন আমজাদ হোসেন। ষাটের দশকে এসে তাঁর তীক্ষè লেখাতে জটিল জীবনের প্রাণবন্ত ছবি পাঠক সমাজকে চমকে দেয়। চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি যেমন আপোষহীন শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও প্রকৃত গুণী লেখকের একজনও বটে। কিন্তু তাঁর বহুমাত্রিক সফল পদচারণার ফলে সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্ম অনেকটা অনালোচিতই রয়ে গেছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে ছিল তাঁর অসাধারণ মমতা ও আস্থা। সম্প্রতি প্রয়াত আমজাদ হোসেনের এক স্মরণানুষ্ঠানে তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার চৌধুরী বলেনÑ ‘তাঁর সব সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার সাক্ষী আমি। গল্প লিখতে লিখতে ভোর হয়ে গেলে তিনি বলতেন, দেখো এই লেখাগুলোই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।’ প্রকৃতপক্ষে তাঁর উপন্যাস ও ছোট গল্পগুলো বাংলা কথাসাহিত্যকে করেছে ঋদ্ধ। ২৫ মার্চের কালো রাত্রি এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি দেখেছেন খুব কাছে থেকে এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছেন। আর এই অভিজ্ঞতার নির্যাস থেকে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য রচনায় আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিমিত বোধের মধ্য দিয়ে এক সফল ও স্বাতন্ত্র শিল্পসত্তার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পর পর অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনায় হাত দিলেও আমজাদ হোসেন এক্ষেত্রে সময় নিয়েছেন। সম্ভবত দূরদৃষ্টি দিয়ে তিনি যুদ্ধের অনুভ‚তিকে বুঝার সুযোগ নিয়েছেন এবং খানিকটা সময় নিয়ে, দম ফেলে ফেলে- ‘অবেলায় অসময়’ (১৯৭৪), ‘অস্থির পাখিরা’ (১৯৭৬), ‘জন্মদিনের ক্যামেরা’ (১৯৮৪), ‘যুদ্ধে যাবো’ (১৯৯০), ‘যুদ্ধ যাত্রার রাত্রি’ (১৯৯১), ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধের আখ্যায়িকা রচনা করেন। সবক’টি উপন্যাসেই মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত নানামাত্রিক ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা খন্ড খন্ড ভাবে হৃদয়গ্রাহী করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। সবক’টি উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহকে একই সমান্তরালে নিয়ে আসলে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের একটি আনুপূর্বিক বর্ণনাই ওঠে এসেছে বলা যায়। অর্থাৎ আমজাদ হোসেনের এই উপন্যাস সমগ্রে পাঠক মুক্তিযুদ্ধের আদ্যপান্ত ঘটনাবলির রস আস্বাদনে সক্ষম হবে। আমাদের সাহিত্য সমালোচক এবং উপন্যাসিকদের মতে বাংলা সাহিত্যে এখনো মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি রচিত হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধকে অনুষঙ্গ করে প্রায় পাঁচ দশকে কম সাহিত্যও রচিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাসে এখনো শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি রচিত না হলেও খন্ডিত কাহিনি নিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি কর্মই রয়েছে।
দুই.
কথাশিল্পী আমজাদ হোসেনের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘যুদ্ধযাত্রার রাত্রী’ ১৯৯১)। ঘটনার সূত্রপাত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকে ঢাকা শহরে যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে তার একটি আনুপূর্বিক বর্ণনা লেখক অত্যন্ত সুনিপুণভাবে কথাসাহিত্যের ভাষায় ও আবহে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান প্রজন্ম এই উপন্যাস পাঠে সহজেই সেই উত্তাল মার্চের একটি নিরেট চিত্র হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। ঔপন্যাসিকের ভাষায়- “৭ই মার্চে, শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই শ্লোগান আর মিছিলের দেশ হয়ে গেছে বাংলাদেশ। উত্তপ্ত, উদ্বেলিত। বিষ্ফোরণমুখ ঢাকা শহরে প্রতিদিনই অসংখ্য মিছিল বেরোচ্ছে। ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করবো বলে প্রত্যেকের হাতেই বড় বড় বাঁশের লাঠি। শ্লোগানে শ্লোগানে ঢাকার আকাশ বাতাস কাঁপছে দিনরাত।” সমগ্রদেশ এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে যে অগ্রসর হচ্ছে তা বুঝে নিতে ঘরের সাধারণ গৃহিণীদেরও উৎবেগের অন্ত নেই। দেশের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে অচিরেই দেখা দেবে বাজারে খাদ্য ঘাটতি। তা মাথায় রেখে দোকানে দোকানে সওদার ধুম পরে গেছে। গৃহিণীর কথা কর্তার মনে পড়ে এভাবেÑ ‘হঠাৎ রতœার কথা মনে পড়লো, কিছুক্ষণ আগেই সে বলেছে শহরের অবস্থা ভালো না। রতœা কি তাহলে পাখির মতো ঝড়ের সংকেত টের পায়। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বাজারে ঢুকলাম।’ এহেন এক বাস্তব পরিস্থিতির শৈল্পিক বর্ণনার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্বের পটভ‚মিকে উপজীব্য করে ‘যুদ্ধযাত্রার রাত্রি’ গতিময়তা লাভ করে।
ভয়াল ২৫ মার্চের কালো রাত্রির সেই ভয়ঙ্কর সময়ের বর্ণনা মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মিতে রচিত অনেকের উপন্যাসেই ওঠে এসেছে বটে। কিন্তু আমজাদ হোসেন রচিত এ উপন্যাসটিতে সেই কালো রাত্রির ঢাকা শহরের আওলাদ হোসেন লেইন-এর কতিপয় বাসিন্দাদের মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পুরো ঢাকা শহরের পরিস্থিতিকেই সহজেই অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না।
‘যুদ্ধযাত্রার রাত্রি’ কথা সাহিত্যিক আমজাদ হোসেনের অনেকটা বাস্তব অভিজ্ঞতার শৈল্পিক নির্যাস। ২৫ মার্চ থেকে দিন দুই-এর ঘটনার বর্ণনাতে ঢাকা শহরে কী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও তাÐব চলেছিল তা ঐ আখ্যানটিতে মূর্ত হয়ে ওঠেছে। আওলাদ হোসেন লেইন-এর আশপাশের বর্ণনা এবঙ পাশাপাশি দুটি মুসলিম ও হিন্দু পরিবারের উপস্থিতিতে লেখক অত্যন্ত সূ²ভাবে ২৫ মার্চের কালো রাত্রি এবং তার পরবর্তী দিনের ভয়াবহ পরিস্থিতিকে হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করেছে। এমনতর সংকটময় চরম মুহূর্তেও দুটি হিন্দু মুসলিম পরিবার রত্না ও সুজাতার মধ্যে যে বিপদকালীন সখ্যতা ও পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ লেখক তুলে ধরেছেন তা যুদ্ধকালীন সময়ের বহু বাস্তব ঘটনার একটি অনন্য রূপায়ন। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের এক মহান ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক সময়ের দু’একটি দিন পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের নির্মম অত্যাচারে ঢাকা শহর যে নরক যন্ত্রণায় পর্যবসিত হয়েছিল তার এক সুনিপুণ বর্ণনা হচ্ছে ‘যুদ্ধযাত্রার রাত্রি’। নামকরণের মধ্যেই যেন নিহিত আছে উপন্যাসের বিষয়-ভাবনা। এই উপন্যাসে গল্পের অনেক চরিত্রই বাস্তব থেকে তুলে এনেছেন লেখক। যেমনÑ পূর্ব দেশ পত্রিকায় সে সময়ে কর্মরত ছিলেন লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী। তাঁর দপ্তরে ঝড়ের মতো প্রবেশ করে মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাদের কথোপকথন গল্পে ওঠে এসেছে। তবে এতে উপন্যাসের শিল্প সৌন্দর্যের কোনো বিঘ্ন ঘটেনি।
তিন.
একাত্তরের যুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে নিছক বিশ্বের আর দশটি যুদ্ধের মতো সীমাবদ্ধ ছিল না। ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মধ্যে যে বৈষম্য, যে সীমারেখা তার নিগড় ভেঙ্গে সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে এক স্বাতন্ত্র ঐক্যের সুর ধ্বনিত হয়েছিল। আর তারই এক চমৎকার রূপায়ণ দেখতে পাই কথাশিল্পী আমজাদ হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের এক কঠিন সময়ের ক্যানভাস ‘অবেলায় অসময়’ (১৯৭৪) উপন্যাসে। জীবন যেখানে বিপন্ন প্রায়, সেই মুহূর্তে জীবনের প্রয়োজনে সামাজিক আচরণ ও ধর্মের বিধি-বিধান গৌণ হয়ে যায়, এটাই সত্য। আর এই কঠিন সত্যটিকে মুক্তিকামী বাঙালি যুদ্ধের বিভীষিকাময় মুহূর্তগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করে নিয়েছিলেন। জীবন বাঁচানোর শেষআশ্রয়ে একটি ছোট নৌকায় গাদাগাদি করে ওঠে পড়ে শিশু, বৃদ্ধ, সদ্য সন্তান হারানো মা, গুলিবিদ্ধ নববধূ, মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকেই। সেই নৌকায় প্রাণপন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে শিশুর জীবন বাঁচাতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোন সীমারেখা দেখতে পায়না হাওয়া ও ব্রজরানী- ‘ঝট করে ব্রজরানীর কোল থেকে ছেলেটিকে টেনে নিয়ে হাওয়া তার মুখে পুরে দিলো দুধ ভরা একটা স্তন। ছেলেটা হাউস-ফাউস করে খেতে লাগলো সেই দুধ। এ দৃশ্য দেখে সবাই অবাক। এক মুসলমান বুকের দুধ খাচ্ছে ব্রজরানীর ছেলে। হাওয়া বিবির প্রতি শ্রদ্ধায় পুরুষদের মাথা অনেকটা নীচু হয়ে গেল। মেয়েদের চোখ কান্নার জলে টলমল করে ওঠলো। ব্রজরানীর শ্বশুর রামকৃষ্ণ বাবু তাড়াতাড়ি বুক পকেট থেকে পেুলের একটা রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি বের করে ছুড়ে মারলো নদীতে। অকুল ঘোলাটে জলের ভিতরে ডুবে গেল রাধাকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণ বাবু জোড় হাতে প্রণামের ভঙ্গিতে হাওয়াকে বলল, ‘তুমি যা দিলে, তার কাছে ঐ পেুলের মূর্তি হেরে গেল মা। দেবীর আসন তোমারই হওয়া উচিত।’ বস্তুত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এখানে আর সাধারণ কোনো যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। যুদ্ধের এক কঠিনতর মুহূর্তে শরণার্থীরা যখন সীমান্ত পাড়ি দিতে প্রাণান্তর চেষ্টা করে ছুটছে তো ছুটছে, তখন এ জাতির অনেক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে মুক্তিকামী বাঙালিকে। সে সময়ের ঘটনার বাস্তবতাকে অবলোকন করে উপন্যাসের ক্যানভাসে যে শৈল্পিক রূপায়ণ, এখানেই কথা শিল্পী আমজাদ হোসেনের শিল্পের অনন্যতা।
এই নৌকার যাত্রীদের শেষ গন্তব্য কলকাতার বর্ডার। এই বর্ডারে পৌঁছতে পারলেই যেন সবাই প্রাণে বেঁচে যায়। প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারে। তাই তো সবার উদ্বেগের শেষ নেই, এই গন্তব্য আর কতদূর? নৌকার মধ্যে আছে সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী কাশেম-সখিনা। পাক বাহিনীর হাতে সদ্য সন্তান হারানো মা হাওয়া বিবি, বাবা আদম, ব্রজরানীর বুকের দুধ না পাওয়া শিশু সন্তান, বৃদ্ধ শ্বশুর রামকৃষ্ণ, মহিয়সী মা, জসিমুদ্দিন, জনসন গোমেজ, বৈষ্ণবসহ নানা ধর্ম-গোত্রের যেন আদিম মানব মানবী। প্রাণে বাঁচার তাগিদে গন্তব্যের দিকে ধীরলয়ে ছুটে চলেছে আলী মাঝির সেই নৌকা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাসের এক খÐিত চিত্র এই নৌকার পথ চলায় যেন সমগ্র বাঙালি সত্তাকে এক সুতার মালায় নিয়ে আসে। এই আলী মাঝির নৌকা এবং যাত্রীদের যাত্রা পথ কোন সাধারণ যাত্রা নয়। এই একটি মাত্র নৌকাই কথা শিল্পী পুরো মুক্তিযুদ্ধের এক বিশাল পটভ‚মিকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছেন।
দীর্ঘ যাত্রাপথে নৌকা থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে গেলÑ পচা, বরকত, কাশেম, সাকিনা। আলীর মনে কেমন যেন একটি হতাশার ঢেউ উঠল, তাদের হারিয়ে যাওয়ার কথা মনে হতেই। নৌকার সবাই কি এমনভাবে এক এক করে হারিয়ে যাবে। যুদ্ধের বিভীষিকা লেখককে এতাটাই আবেগ তাড়িত করে তুলেছে যে, আখ্যানের শেষাংশে এসে নৌকার সকল যাত্রীদের এক করুন পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে এবং শেষ পর্যন্ত কোন আলোর নিশানা না দেখিয়ে আবারও এক অন্ধকার, অজানা গন্তব্যের দিকে নৌকা ছাড়লো মাঝি। কিন্তু পাঠক আশা করেছিল হয়তো এতটা কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার পর হলেও যারা প্রাণে বেঁচে আছে তারা হয়তো শেষ পর্যন্ত কলকাতা সীমান্তে পৌঁছবে। কিন্তু না, ঘটনার নাটকীয় মোড় লক্ষণীয়।
নৌকায় চোখ পরে পাকহানাদার বাহিনীর। তারা নৌকায় উঠতে আসলে যাত্রীরা নৌকার পাটাতনে শেষ আশ্রয় নেয়। ঔপন্যাসিক এখানে মুক্তিযুদ্ধের এই দুর্গম পথকে সহজেই পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্যের বার্তা অতসহজেই দিতে চাননি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নদীপথের অনেক লোমহর্ষক ঘটনা রয়েছে বটে। তবে নৌকার সকল যাত্রীর দুর্বিষহ জীবনাবসানের চিত্র আঁকতে গিয়ে মনে হলো ‘অবেলায় অসময়’ উপন্যাসে লেখক একটু বেশি আবেগ তাড়িত হয়ে কাহিনিকে বিন্যস্ত করেছেন। তবুও আমাদের মুক্তি সংগ্রামে নদীপথের এই চিত্রায়ণ হাজারো ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করে।
চার.
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের স্বপ্নভঙ্গের এক গভীরতম যাতনা নিয়ে রচিত হয় ‘অস্থির পাখিরা’ (১৯৭৬)। বিশাল এক স্বপ্নের পাহাড় নিয়ে স্বাধীনতার যে লাল সূর্য অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, তা কীভাবে চোখের সামনে বিধ্বস্ত হতে চলেছে তার এক বাস্তব রূপায়ন কথা শিল্পী আমজাদ হোসেনের কলমের তুলিতে ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। যুদ্ধ ফেরত আদর্শবান তরুণ রোকন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের দুঃখ-ক্লিষ্ট এক পিতাহারা অসহায় পরিবারের একমাত্র ভরসা মিনতি এবং অপরদিকে যুদ্ধফেরত পথভ্রষ্ট রোকনের অপর বন্ধুরা। এই ত্রিমুখী চরিত্রের আদর্শ বেষ্টন করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সমাজ বাস্তবতার এক অনুষঙ্গের চিত্র পাঠক দেখতে পায় এই উপন্যাসে। শুধুমাত্র আমজাদ হোসেন নয় আরও অনেক কথাসাহিত্যিকের হাত ধরে সেদিন এই স্বপ্নভঙ্গের কতকথা রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। ‘আবার তোরা মানুষ হও’- এর মতো চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছিল যন্ত্রণাকাতর নির্মাতাদের হাত ধরে। আর এই অস্থির সময়ের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন বাংলা কথা সাহিত্যে আমজাদ হোসেনের অস্থির পাখিরা।
স্বাধীনতা সংগ্রামে বাপ-মা, ভাই-বোন হারানো এক মুক্তিযোদ্ধার নাম রোকন। যুদ্ধফেরত এই মুক্তিযোদ্ধার সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে একটি স্বাধীন দেশ ও আদর্শের মর্যাদা। কিন্তু এক বুক আশা আর আদর্শ নিয়ে যুদ্ধফেরত এই মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখে কী দেখছেÑ ‘দেশের মাটিতে ফিরে এসেই একদিন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দারুণ ঝগড়া বাঁধলো রোকনের। তাদের হাতে অস্ত্রকে কিছুতেই অসৎ কাজে ব্যবহার করতে দেবে না রোকন। যে অস্ত্র পরম বন্ধুর মতো ন’মাস সঙ্গে থেকেছে। গোলাবারুদ ছুঁড়ে ছুঁড়ে জীবনকে রক্ষা করেছে। যে অস্ত্রের জোরে বাংলা মাকে আবার ফিরে পেয়েছি আমরা, সেই অস্ত্র দিয়েই আজ তারা লুটপাট করবে। অযথা রক্তপাত ঝরাতে। না, আমি থাকতে তা হতে দেবো না, কোনদিন। সেদিন সিংহের মতো তার গগণ কাঁপানো গর্জনে সবাই কেঁপে উঠেছিল একসঙ্গে।’ কিন্তু রোকনকে তার আদর্শ নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে দিল না তার কতিপয় সেই একাত্তরে অস্ত্রধরা বর্তমান পথভ্রান্ত বন্ধুরা। যে আদর্শ বুকে ধারণ করে একাত্তরে অস্ত্র ধরেছিল। সে আদর্শকে পদধ্বলিত করে আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়ল এক সময়ের সহযোদ্ধা বন্ধুরা রোকনের ওপর। ‘‘একদিন রাত্রে অতর্কিতে ধরে ফেললো রোকনকে। সবার কাছেই অস্ত্র ছিল কিন্তু কেউ একটা গুলি করল না রোকনকে। শুধু চোখ দু’টো অন্ধ করে রেখে গেল।” জীবনের এই পরিণতির জন্য, স্বপ্নভঙ্গের এই যাতনা বুকে নিয়ে রোকন হাসপাতালে নিজের রিভলভার দিয়ে আত্মহত্যা করে দেশের এই পরিণতি থেকে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন নার্সের প্রতিরোধ এবং মিনতির প্রতিজ্ঞার কারণে সে যাত্রায় রোকনকে বেঁচে থাকতে হয়। কিন্তু রোকনের হৃদয় রিভলভারের বারুদের গন্ধের মতো ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। নিজের চেয়েও জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দেয় তার রিভলভারটি। তাই তো মিনতির কাছ থেকে অস্ত্র ফেরত পেয়ে রোকনের মন্তব্যÑ ‘ভেতরে বারুদ না থাকলে রোকন মৃত। এটার ভেতর বারুদ আছে বলেই তো ওর নাম এখন রোকন।’ শিল্পীর কলমের অল্প আচরে স্বাধীনতা পরবর্তী সমাজ বাস্তবতার এক কঠিন রূপ উদ্ভাসিত হয়েছে রোকনের এই বক্তব্যে।
একজন আদর্শ, স্বপ্নভঙ্গ, অন্ধ, অসহায় মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র রোকন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সমাজে অত্যাচার অবিচার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। লুটতরাজ, খুন-খারাবি বেড়ে যায়। আততায়ীর গুলিতে নিহত হচ্ছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। আর এসব মুখ বুজে সব শুনতে হচ্ছে রোকনকে। কিন্তু চোখে দেখতে পাচ্ছে না। এক সময় রোকনের ইচ্ছে হয়, কান দুটোই যদি কেটে ফেলা যেত, তা হলে আর অবক্ষয়ের ধ্বনিও শুনতে হতো না। শুধু রোকন নয় সমাজে তখন হাজারো বীর মুক্তিযোদ্ধা অসহায়ের মতো যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে। আর অপর দিকে আদর্শ বিচ্যুত বিপদগামী এক দল তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সমাজে ভয়ংকর নেশায় মেতে ওঠেছে। মূলত সৃষ্টিশীল সাহিত্য সমকাল দর্পণও বটে। বস্তুত এক আদর্শ মুক্তিযোদ্ধা রোকন সমাজের অসহায় মিনতি এবং পথভ্রষ্ট তরুণ চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমকালীন অস্থির এক সমাজ ব্যবস্থার চিত্রায়ণ করেছেন লেখক তাঁর ‘অস্থির পাখিরা’ উপন্যাসে।
এই উপন্যাসের পটভ‚মি যুদ্ধপরবর্তী সময়ের অবক্ষয়িত সমাজ বাস্তবতার নিরীখে রচিত হয়েছে বটে। তবে অনেক ক্ষেত্রে লেখক নিজেই একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে স্বাধীনতা পরবর্তী এই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ব্যথিত হয়ে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আর এই নিয়ন্ত্রহীন আবেগ লেখকের শিল্পসত্তাকে অনেক ক্ষেত্রে কুণ্ঠিত করেছে। তবে সমকালীন সমাজ বাস্তবতায় লেখকের এই দৃষ্টিপাত, অসঙ্গতির নানা অনুষঙ্গ, বর্ণনা বিন্যাস, শব্দ প্রয়োগ, শিল্পরস সব মিলিয়ে এই অনু উপন্যাস ‘অস্থির পাখিরা’ মুক্তিযুদ্ধের কথাসাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে।
পাঁচ
‘যুদ্ধে যাবো’(১৯৯০), স্বাধীনতা সংগ্রামের যে বিশাল পেক্ষাপট তাকে বেষ্টন করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার চিত্রায়নে এক অনু উপন্যাস। যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি থেকে শুরু করে নয় মাসের যুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন সহ যুদ্ধ পরবর্তী আঠারো বছর স্বাধীন দেশের অনেক স্বপ্নভঙ্গ ও হতাশার চিত্র একজন মুক্তিযোদ্ধা সূর্যকে বেস্টন করে চিত্রায়িত হয়েছে।
আর দশটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের মতো ঢাকা শহরের ২৫ মার্চের কালোরাত্রির এক লোমহর্ষক বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও যে যুদ্ধ চলছিল তারও বর্ণনা পাওয়া যায় অনাগত মুক্তিযোদ্ধা সূর্যদের মতো তরুণদের মুখে। অর্থাৎ যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই বাঙালির যে শক্ত মনোবল ছিল তারই ইঙ্গিতবহ। সূর্য আগামীকাল চলে যাবে ভারতে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। আজ রাতেই প্রেয়সি ঋতুর সাথে শেষ দেখা। এই মুহূর্তে সূর্যের কাছে ঋতু নয়, দেশ মাতৃকাই অনেক বড় হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে। তাই তো সূর্যের উক্তিÑ ‘‘রক্ত মাংসের শরীর ছুঁয়ে লাভ কি ঋতু। আমাদের লাশ শেয়াল-শকুনে খাচ্ছে, তুলে আনতে পারছি না। আমাদের মাটি পুড়ে যাচ্ছে। ফসল নষ্ট হচ্ছে। শহর জ্বলে যাচ্ছে। যে শিশু ভুমিষ্ট হয়ে জায়গা চাইবে আমরা তার সেই ভ‚-খÐ হারাচ্ছি।’’ এ বক্তব্য একজন যুদ্ধগামী ছাত্রের কোনো আবেগের বক্তব্য নয়। সে সময়ে ছিল এটি বাস্তবে, হৃদয় নিংড়ানো মনের কথা। তরুণদের মনে এই শক্তি ছিল বলেই দেশ স্বাধীন হতে পেরেছিল। আর এমনতর বাস্তবতাকে অবলম্বন করে পল্লবিত হয়েছে আমজাদ হোসেনের ‘যুদ্ধে যাবো’ উপন্যাসের কাহিনি।
মুক্তিযোদ্ধাদের বীরেরবেশে বাড়ি ফেরার যে চিত্র সদ্য স্বাধীন দেশে ঘটেছে তারও এক উজ্জ্বল বর্ণনা আছে। সেটিকে আরও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে তাজউদ্দীন আহমেদের বক্তৃতা। “তাজউদ্দিন সাহেবের আবেগাপ্লুত বক্তৃতা শুনে সূর্যও কেঁদে ফেলেছিল এক সময়। আসলে তাঁর বক্তৃতায় দীর্ঘ এই ন’ মাসের স্বজন হারানো দুঃখ কেঁদে উঠেছিল। বিজয়ী স্বাধীনতার প্রথম দিন বোধ হয় পৃথিবীর সব দেশের মানুষই এভাবে কেঁদে ফেলে।” (পৃষ্ঠা : ২২৫) স্বাধীন দেশের প্রথম দিনের বর্ণনার অনুভ‚তি একজন মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে লেখক হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।
যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধা সূর্য স্বদেশে পা ফেলে দেখতো পেলÑ যুদ্ধের কাজ এখনো শেষ হয়নি। চর্তুদিকে এতো ক্ষয়ক্ষতি প্রিয়জন হারানোর বেদনা আর অসংগতি দেখে তিনি স্থির থাকতে পারছেন না। “মীরপুরের বধ্যভ‚মি দেখে পাগলের মতো দিন রাত ঘুরে বেড়াচ্ছে সূর্য। বুকের ভেতরে আগুন জ্বলছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে যারা জড়িত ছিল, হানাদার বাহিনীকে যারা এদের বাড়ি ঘর দেখিয়ে দিয়েছে সেইসব রাজাকার আলবদরকে ধরে ধরে আনছে। শাস্তি দিচ্ছে। কী সাংঘাতিক। মরে যাবে তবু তারা স্বীকার করবে না।” স্বাধীন দেশে পা-ফেলে যেন তিনি আর এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। দেশ মাতৃকার জন্য একজন লড়াকু সৈনিকের ভ‚মিকাকে লেখক অত্যন্ত সু² ও তী² দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
গল্পের পরিসমাপ্তিতে এসে ঔপন্যাসিক যে নাটকীয় ঘটনার অবতারণা করেছেন ঋতু ও টুলটুলের ট্রাজ্যিক পরিণতির মধ্য দিয়ে তাও কিন্তু সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যদিও বা এ ঘটনায় শুধুমাত্র সূর্য নয় সমস্ত পাঠক সমাজই যেন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ল। ঋতু পাকহানাদার বাহিনীদের থেকে নিজের আব্রæ রক্ষা করতে গিয়ে নিজেই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়েছে। তবুও সূর্যের শেষ সান্ত¡না ঋতুদের এই আত্মত্যাগের ফলেই আজ আমাদের এই লাল সূর্যের দেশ। কিন্তু তবু সূর্যের জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে না, স্বাধীনতার আঠারো বছর পরও। তাই তো একদিন হাত পা বাঁধা টুলটুলের লাশ পড়ে থাকতে দেখে পাড়ার গলিতে। সমাজের এই অবক্ষয় আর মেনে নিতে পারে না সূর্য। আবার গর্জে ওঠে তার হাতের অস্ত্র। নয় মাসের সেই উত্তপ্ত দিনগুলি জ্বলে ওঠে। চিৎকার করে সূর্য বলে ওঠে ‘‘আমাকে ছেড়ে দিন, আবার যুদ্ধে যাবো, আরেকটা যুদ্ধ চাই।” যুদ্ধ যাওয়ার প্রস্তুতি থেকে নয়মাসের যুদ্ধ হয়ে যুদ্ধপরবর্তী আঠারো বছরের স্বাধীনদেশের দ্রষ্টা এক অনন্য মুক্তিযোদ্ধা সূর্য। তাঁকে বেষ্টন করে মুক্তিযুদ্ধের এবং পরবর্তী দীর্ঘ সময়ের খÐ খÐ অনেক চিত্রই উদ্ভাসিত হয়েছে শৈল্পিক রূপায়ণে এই উপন্যাস।
‘যুদ্ধে যাবো’ উপন্যাসটিতে মুক্তিযুদ্ধের এক বিশাল পটভ‚মিতে দীর্ঘ সময়ের ইঙ্গিত আছে মাত্র। নানা ঘটনার এক পরিপূর্ণ চিত্রায়ন হতে পারতো। হতে পারতো আমাদের গৌরবগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মিতে এক সম্পূর্ণ উপন্যাসও, যা বাংলা সাহিত্যে এত বছর পরও আজও রচিত হয়ে উঠেনি। কিন্তু না! লেখক আমজাদ হোসেনের কাহিনিবিন্যাসেও শৈল্পিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি আর হয়ে ওঠে নি। ‘যুদ্ধে যাবো’ উপন্যাসটি অতি দ্রæততার সাথে পরিসমাপ্তি ঘটাতে গিয়ে আর দশটি মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের মতো একই সীমারেখায় আটকে গেল।
ছয়.
কিশোর উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেও আমজাদ হোসেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন আমাদের কথাসাহিত্যে। এই জাদুময় কথাশিল্পী কিশোর উপন্যাসে অনন্য অবদানের জন্য পরপর দুবার অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার অর্জন করে চমকে দিয়েছে আমাদের শিশুসাহিত্য অঙ্গনকে। কিশোর অনু উপন্যাস ‘জন্মদিনের ক্যামেরা’ (১৯৮৪), কথাশিল্পী আমজাদ হোসেনের এক গুচ্ছ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে এক অনন্য সংযোজন।
মূলত এই আখ্যানটিতে লেখক পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরেছেন, কীভাবে একজন দশ বছরের শিশুও আমাদের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগামের যুদ্ধে সামিল হয়ে জাতির এক ক্রান্তিকালে বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছিল। মাত্র দশ বছরের অদ্বিত কীভাবে তার বাবা থেকে প্রশিক্ষণসহ পাওয়া ক্যামেরাটিকে মুক্তিসংগ্রামে নিজ জীবনকে বিসর্জন দিয়ে হলেও কাজে লাগিয়েছিল তার এক আনুপূর্বিক বর্ণনা পাওয়া যায় জন্মদিনের ক্যামেরা উপন্যাসে। মুক্তি সংগ্রামের সময় এ ধরনের অনেক শিশুরাই যুদ্ধে নানাভাবে অংশগ্রহণ করে বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছিল। আর এ সমস্ত অসংখ্য বাস্তব ঘটনার একটিকে শিল্পে রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন কথাশিল্পী আমজাদ হোসেন।
গল্পের শুরুতেই অদ্বিতকে আর দশজন থেকে আলাদা করে উপস্থাপন করেছেন লেখক। কারণ মাত্র দশ বছরের শিশু মুক্তিযোদ্ধা অদ্বিত তো আর সমাজে যত্রতত্র জন্মায় না, দু’চারজন জন্মায় মাত্র। ‘‘অদ্বিত! বাহ্ কী সুন্দর নাম! যার কোন দ্বিতীয় নেই। অদ্বিতীয়। তার কোন ছবি দেখলেই বুঝতে পারবে অদ্বিতের চেহারাটাও সবার চাইতে আলাদা।’’ অদ্বিতের জন্ম ২৫ শে মার্চ ১৯৬১, এবার ১৯৭১, ২৫ শে মার্চ তার দশ বছর পূর্ণ হবে। ভাষা সৈনিক, লেখক ও আলোকচিত্রী মুজিব রহমান ও তার স্ত্রীর ইচ্ছে, খুব ধুমধাম করে এবারের জন্মদিন পালন করা হবে। ইতোমধ্যে ছেলেকে ছবি তোলার যাবতীয় কৌশলও শিখিয়েছে। সে রাতে জন্মদিনের আয়োজনেরও কোন কমতি রাখেনি এই দম্পতি। কিন্তু সেই শুভ রাত পরক্ষণেই এক কালো রাত্রিতে রূপ নিল। মুহূর্তের মধ্যেই সব স্বপ্ন ভেঙ্গে রক্তের স্রোতে ভেসে গেল। ‘খেতে বসবে, ঠিক তখনই স্টেনগান মর্টারের শব্দে থর থর করে কেঁপে উঠল ঢাকার শহর। যেন ঢাকার আকাশে শুধু আতসবাজি উড়ছে আর পড়ছে।… রক্তাপ্লুত মেঝ। সেই মেঝের উপর পড়ে আছে বাবা-মার রক্তাক্ত দেহ। সিঁড়ির কাছের দরজাটা খোলা। হা হা হয়ে আছে। জন্মদিনের উপহারগুলো পড়ে আছে এখানে সেখানে।’ জন্মদিনের রাতে সব হারিয়ে বোবা অদ্বিতের সামনে পাওয়া বাবার সেই ক্যামেরাটি শুধু কথা বলে উঠল। তার মুখের শক্তি রূপান্তরিত হলো ক্যামেরার শক্তিতে। নয় মাসের রক্তঝরা দিনগুলোর অনেক ঘটনাই ক্যামরাবন্দি করল শিশু অদ্বিত। ‘সবচাইতে খারাপ লেগেছে মিলিটারিরা যখন হাত-পা-চোখ বাঁধা মানুষগুলোকে নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছিল, তখন গোপনে ছবি তুলতে গিয়ে ডান পায়ে একটা গুলি খায় অদ্বিত। গুলিটা ভেতরে নেই, এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয়ে গেছে।’এমনতর এক কঠিন সময়ের মধ্যেও অদ্বিত ক্যামেরা চালিয়েছে নিরন্তর। যুদ্ধ শেষ, ক্যামেরা চালানো শেষ, অদ্বিতও শেষ। শুধু অক্ষত আছে তার দুর্দিনের একমাত্র সঙ্গি প্রিয় কুকুরÑ ড্যানি! আর তখন মিরপুর দখল করে ফেলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। ‘অদ্বিত আর নেই। কিন্তু অদ্বিতের তোলা নয় মাসের অনেক মূল্যবান ছবি পেল এদেশ। ড্যানি সব বের করে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধারা ফিল্ম ডেভেলাপ করেছে। পত্র-পত্রিকায় জানিয়ে দিয়েছে অদ্বিতের কথা।… অদ্বিতকেও একজন মুক্তিযোদ্ধা বলে স্বীকার করেছে দেশ। এই দশ বছরের ছোট অদ্বিতের তোলা বিগত নয়মাসের এত ছবি দেখে, অবাক হয়ে গেছে দেশের মানুষ।’
অদ্বিত ও তার পরিবারের ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে মূলত নয়মাসের শ্বাসরূদ্ধ যুদ্ধদিনই বাঙালি জাতির আত্ম পরিচয়ের সোপান রচিত হয়েছে। আমাদের শিশু মুক্তিযোদ্ধাদের এই রকম হরেক ঘটনার ফলশ্রæতিতেই মূলত স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হয়েছিল। কিশোর মুক্তিযোদ্ধার অসংখ্য ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে শিল্পী আমজাদ হোসেন এক কুশলী মনের পরিচয় দিয়ে ‘জন্মদিনের ক্যামেরা’ কিশোর উপন্যাসটির পটভ‚মি নির্মাণ করেন। এখানে লেখক তাঁর শিল্পবোধকে অক্ষুন্ন রেখে একটি পরিবার ও শিশু অদ্বিতকে যেভাবে একজন শিশু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাসে তা এক ব্যতিক্রম ও অনন্য সংযোজন। যুদ্ধের স্মৃতিকে ধারণ করে এ ধরনের মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস যুগ যুগ ধরে বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্মৃতিকে বহমান রাখবে।
সাত.
কথাসাহিত্যিক আমজাদ হোসেনের একগুচ্ছ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের ভাষা ব্যবহার, শব্দ চয়ন, ছোট ছোট বাক্য গঠন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও রূপকের বিন্যাস, এবং বর্ণনার চমৎকারিত্ব, ঘটনার নাটকীয় মোড় পাঠক মনকে চমকে দেয়, আন্দোলিত করে, শিহরণ জাগায় এবং আলোড়িত করে তুলে অতি সহজেই। ‘যুদ্ধ যাত্রার রাত্রি’ উপন্যাসের কিয়দ অংশের শৈল্পিক রূপÑ “মার্চ মাসের বিকেলও সহজে শেষ হতে চায় না। ভাঙা ভাঙা টুকরো রোদ নিয়েও অনেকক্ষণ থাকে। সূর্য ডুবে গেলেও আতশী কাচের মতো তার আভা থাকে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর সন্ধ্যা গাঢ় হয়। আজকের এই নিঝুম সন্ধ্যা আরও বিভীষিকাময় লাগছে। ভয়াবহ এক আতঙ্ক নিয়ে আসছে এই সন্ধ্যা। কাল রাতে যা হয়েছে আজ তার চেয়েও বেশি গোলাগুলি হবে। ঢাকা শহরের কোন চিহ্নই তারা রাখবে না। মাটিতে মিশিয়ে ফেলবে এই শহর।’’ ২৬ মার্চ ৭১-এর ঢাকা শহরের বৈকালিক আবহ ও মনোজগতের কষ্টের-উৎবেগের ক্ষতচিহ্ন কথাশিল্পী তাঁর মনের শৈল্পিক মাধুরী মিশিয়ে হাজারো মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন এভাবে। পাঁচটি গুচ্ছ উপন্যাসের ঘটনা, বিষয়বস্তু, স্থানের বর্ণনা, সময়কালকে তী² দৃষ্টি দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে প্রত্যক্ষ করে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উপন্যাস রচনায় অগ্রসর হয়েছেন। সবকটি উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সমকালের পরিবেশ-পরিস্থিতি, পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর অত্যাচার উৎকণ্ঠা-উৎবেগ, শরণার্থীদের পালিয়ে যাওয়ার করুণ চিত্র, পাকহানাদার বাহিনীর বিভৎস হত্যাকাÐ অত্যন্ত চমৎকারভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। পাঁচ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের পাঁচটি অধ্যায়কে উন্মোচিত করার চেষ্টা ও পরিকল্পনা নিয়েই যেন লেখক অগ্রসর হয়েছেন। এই উপন্যাস গুচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্রচিত্রকে ধারন করার প্রচেষ্টা ছিল লেখকের। লেখক নিজেই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি তাঁকে উদ্বেগ-উদ্বেলিত করে অনেকের চেয়ে বেশি। তাঁর হৃদয় যন্ত্রণা থেকে হয়তো তিনি কলম ধরেছেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সমাজ বাস্তবতাকে সাহিত্যে রূপ দিয়ে সমকালকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর ‘অস্থির পাখিরা’, ‘যুদ্ধে যাবো’, ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রিক উপন্যাসগুলি।
কথাসাহিত্যিক আমজাদ হোসেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গুচ্ছ উপন্যাসগুলোর উৎসর্গ পর্বেও ধারণ করেছেন এক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে। উৎসর্গ করেছেন যারা মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই শুধু ক্ষান্ত হননি, মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে এদের অনেকেরই মহান আত্মত্যাগও। এদের মধ্যে আছেনÑ লেখকের ভাষায়Ñ ‘জাহানারা ইমামÑ রুমিকে হারিয়ে আমাদের মা হয়েছেন তিনিই’ (প্রথম উপন্যাস- ‘যুদ্ধ যাত্রার রাত্রি’)। মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করে বেড়ে তিন বন্ধুকে উৎসর্গ করেনÑ ‘অবেলায় অসময়’। এরা হচ্ছেনÑ শাহাদাৎ চৌধুরী, মুনতাসির মামুন, শেখ আবদুর রহমান। তৃতীয় উপন্যাস ‘অস্থির পাখিরা’ উৎসর্গ লেখকের ভাষায়Ñ ‘মিনতি মরে গিয়ে বেঁচে আছে, আমি বেঁচে আছি মিনতির জন্যে।’ এ এক মহাকাব্যিক উক্তি। কারণ মিনতিদের আত্মত্যাগের ফলেই আজ আমরা স্বাধীন দেশে বেঁচে আছি। এর চাইতে বড় কথা আর কি হতে পারে। চতুর্থ উপন্যাস ‘যুদ্ধে যাবো’ উৎসর্গ পর্বে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দুঃসময়ের আর এক অকুতোভয় সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ করা বীরের সন্তান জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। সর্বশেষ সংযোজন কিশোর উপন্যাস ‘জন্মদিনের ক্যামেরা’ মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম, লেখকের আত্মজা শুক্লা ও সোহেল আরমানকে। লেখক অত্যন্ত সচেতনভাবেই এই উৎসর্গ পর্বটিও সম্পন্ন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য রচনায় এই উৎসর্গ পর্বেও যেন লেখকের রয়েছে যুদ্ধ-প্রীতির এক শৈল্পিক পরিকল্পনাও।
সবক’টি উপন্যাসেই সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনা, বর্ণনা খুব একটা ওঠে আসেনি। অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধের কথাসাহিত্যে এই কঠিন এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি খুব কম লেখকেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সম্ভবত আমাদের কথাসাহিত্যিকরা তেমন কেউ সম্মুখ যুদ্ধের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারেনি বলে। মুক্তিযুদ্ধের কথাসাহিত্য বিশ্লেষণ করলে এই উল্লেখযোগ্য দুর্বলতাটি সহজেই ধরা পড়ে। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম এক অনুষঙ্গ হচ্ছে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ লড়াইয়ে অনেক রক্তপাত ও হতাহতের ঘটনা।
বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এক বিশাল ক্যানভাসে। শহর, বন্দর, গ্রাম, জনপদ আক্রান্ত হয়ে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষ। সুতরাং এই বিশাল ক্যানভাসকে সম্পূর্ণ ধারণ করে বাংলা সাহিত্যে এখনো কোনো উপন্যাসের পটভ‚মি চিত্রায়িত হয়নি। আলোচ্য কথাকার আমজাদ হোসেনও ছিলেন নগর কেন্দ্রিক মানুষ। যুদ্ধকে স্বচক্ষে বেশি প্রত্যক্ষ করেছেন নগর জীবনে। ফলে তাঁর উপন্যাসসমগ্রে নগর জীবনের বর্ণনা যেভাবে ঘুরে ফিরে চিত্রায়িত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের গ্রামগঞ্জের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে তিনি ততটা সফলতা দেখাতে পারেননি। তবুও মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পাঁচ দশক পরে এসেও আজকের প্রজন্ম কথাশিল্পী আমজাদ হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের গুচ্ছ উপন্যাস পাঠ করে অনুধাবন করে নিতে পারে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের আত্মত্যাগের বিশাল পটভ‚মি। ইতোমধ্যে বাংলা কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের যে বিশাল সাহিত্য রচিত হয়েছে, এতে কথাসাহিত্যিক আমজাদ হোসেনের অবদানও অকিঞ্চিতকর নয়।
শাকিল আহমদ