আবারও অশান্ত সবুজ পাহাড়

98

ফের অশান্ত হয়ে ওঠেছে পাহাড়। একের পর এক পড়ছে লাশ। গত দু’দিনে ৮ জন খুন হয়েছেন। বিগত ১৬ মাসে খুন হয়েছেন ৭০ জন। এনিয়ে পাহাড়ে বিরাজ করছে আতংক। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার রাঙামাটির বিলাইছড়িতে খুন হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা। এর আগের দিন সোমবার বাঘাইছড়িতে খুন হন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ৭ ব্যক্তি। বাঘাইছড়ির ঘটনায় গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, বাঘাইছড়ির হত্যাকান্ড পূর্বপরিকল্পিত। খাগড়াছড়ি সেনাবাহিনীর রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক বলেছেন, পাহাড়ে দ্রুত চিরুনি অভিযান চালানো হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যৌথবাহিনী কাজ করবে। পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িতদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। অপরদিকে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আজ বুধবার খাগড়াছড়িতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হয়েছে।
জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আলিখিয়ং এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
বাঘাইছড়িতে উপজেলা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষে ফেরার পথে দায়িত্ব পালনকারীদের উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে সাতজনকে হত্যার ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই এ হত্যাকান্ড ঘটলো।
সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গা নৌকায় করে বিলাইছড়িতে ফিরছিলেন। পথে একদল লোক তাকে গুলি করে হত্যা করে।
আগের দিন সোমবার রাতে বাঘাইছড়ি-দিঘিনালা সড়কের নয় মাইল এলাকায় নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বহনকারী চাঁদের গাড়িগুলোর উপর হামলা চালিয়ে ৭ জনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
ভোটগ্রহণ শেষে সন্ধ্যায় সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র থেকে ফেরার পথে নির্বাচনকর্মীদের উপর সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। পাহাড়ে বিবাদমান পক্ষগুলোর একটি জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) এই হামলার জন্য জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) দায়ী করেছে। তবে এতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন সন্তু লারমার দলের নেতারা।
অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সন্তু লারমার দল জেএসএসের বাঘাইছড়ি উপজেলা কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা সাংবাদিকদের বলেন, এই ঘটনার সাথে আমাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। ওই এলাকায় আমাদের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম বা অবস্থানও নেই। ওটা পুরোটাই ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকা।
সূত্র জানায়, গত ১৬ মাস অর্থাৎ ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ফের অশান্ত হয়ে পড়ে পাহাড়। একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটতে থাকে। এ ১৬ মাসে অন্তত ৭০ জন খুন হয়েছেন। পাহাড়ের দুই জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে আঞ্চলিক দলগুলো সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব হামলার ঘটনা মূলত তিনটি আঞ্চলিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এগুলো হচ্ছে ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এবং জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)। এই তিনটি দলের মধ্যে এক পক্ষে ইউপিডিএফ এবং আরেক পক্ষে রয়েছে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। একবার এক বা দুই দলের কেউ আক্রান্ত হলে পরেরবার তাদের প্রতিপক্ষের কেউ হামলার শিকার হচ্ছে। তবে কোনো পক্ষই ঘটনার দায় স্বীকার করে না। পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় হতাহত হচ্ছে সাধারণ মানুষও। তবে এবার আঞ্চলিক দলগুলোর বাইরে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যবস্তু হয়েছে সাধারণ মানুষ।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চুক্তির পর চুক্তির বিরোধিতা করে জন্ম নেয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। সেই থেকে দুই দলের বিরোধে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতে মারা গেছে প্রায় এক হাজার নেতাকর্মী। কিন্তু ২০১৬ সালে দুই দলের মধ্যে অলিখিত ও অপ্রকাশ্য এক চুক্তির ফলে সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ হয়। ফলে স্বস্তির বাতাস নেমে আসে পাহাড়ে। তবে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ এনে ‘পাহাড়ে আবার আগুন জ্বলবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন।
কাকতালীয়ভাবে তাঁর এ ঘোষণার মাত্র দুই দিন পর ৫ ডিসেম্বর অনাধি রঞ্জন চাকমা (৫৫) নামের এক ইউপিডিএফ সমর্থক ইউপি সদস্যকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার জন্য ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিককে দায়ী করে ইউপিডিএফ।
একই দিন রাঙামাটির জুরাছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দ চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গায় ইউপিডিএফের কর্মী ও সংগঠক অনল বিকাশ চাকমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইউপিডিএফ এ হত্যাকান্ডের জন্য নতুন ইউপিডিএফকে দায়ী করে।
৩ জানুয়ারি বিলাইছড়ি উপজেলায় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বরায় তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনার জন্য যুবলীগ জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছিল। একই দিন খাগড়াছড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের অন্যতম নেতা মিঠুন চাকমাকে। ইউপিডিএফ এ হত্যার জন্য ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক দলকে দায়ী করেছে।
৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী মহাসমাবেশে অংশ নেওয়ায় বিলাইছড়িতে আওয়ামী লীগের তিন কর্মীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। এ ঘটনার জন্য সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছিল আওয়ামী লীগ। ২১ ফেব্রæয়ারি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সুভাষ চাকমা নামের একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনিও ইউপিডিএফের কর্মী ছিলেন।
১৭ ফেব্রæয়ারি খাগড়াছড়ি শহরের হরিনাথপাড়া এলাকায় ইউপিডিএফের কর্মী দিলীপ কুমার চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১১ মার্চ বাঘাইছড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের কর্মী নতুন মনি চাকমাকে। ওই দিন রাতে নিজ বাড়িতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নতুন মনি চাকমাকে হত্যা করা হয়। ১২ এপ্রিল পাল্টাপাল্টি হামলায় মারা যান তিনজন। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) এক সদস্যকে গুলি করে হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জনসংহতি সমিতিরও (এম এন লারমা) দুই কর্মীকে হত্যা করা হয়। ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি শহরের পেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় সূর্য বিকাশ চাকমা নামের একজন নিহত হন। ২২ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার মরাটিলা এলাকায় ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা (৪০) নামের এক ইউপিডিএফ নেতা নিহত হন। ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলায় নিজ কার্যালয়ের সামনের সময় গুলি করে হত্যা করা হয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) অন্যতম শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমাকে। এর একদিন পরই ৪ মে শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় অংশ নিতে যাওয়ার পথে সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিকের শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা, তনয় চাকমা এবং গাড়িচালক সজীব।
চলতি সালের ১৪ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির রামগড়ে জেএসএস (এমএন লারমা) এর নেতা মোহন ত্রিপুরা হত্যাকাÐের রেশ না কাটতেই খুন হন ইউপিডিএফ এর সাবেক কর্মী পিপলু ত্রিপুরা (রনি)। এর আগে ৪ জানুয়ারি রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে এক জেএসএস (এমএন লারমা) নেতা বসু চাকমাকে খুন করা হয়। এছাড়া ২৯ জানুয়ারি রাঙামাটির লংগদুতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে পবিত্র চাকমা নামে এক ইউপিডিএফ নেতা নিহত হন। গত ১৫ মার্চ খাগড়াছড়ির পানছড়িতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ইউপিডিএফকর্মী বিনাশন চাকমা নিহত হয়। সাংগঠনিক কাজে গণসংযোগ করার সময় তাকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। ৭ মার্চ রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে চিক্কোধন নামে এক ইউপিডিএফ (প্রসীত) নেতাকে খুন করা হয়। ২০১৮ সালে ২৪ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুইজন প্রাণ হারান। ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় ৬ জন এবং খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সড়কে কেঙ্গালছড়ি এলাকায় ব্রাশফায়ারে ৫ জন মারা যায়।
পাহাড়ে এমন পরিস্থিতির কারণ সম্পর্কে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ওই অঞ্চলে এমন পরিস্থিতি নতুন নয়, এটা দীর্ঘদিনের পুরনো। এটা যেমন নিছক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দুটি দলের অন্তঃকোন্দল। তেমনি নিজেদের ভেতর আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টিও বড় একটি কারণ। এর সঙ্গে রয়েছে চাঁদাবাজির বিষয়টিও। আর পুরো বিষয়ের ভেতর দিয়ে সরকারের ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির উদ্যোগকে অকার্যকর বা বাধাগ্রস্ত করার অপকৌশলও আছে। কারণ শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত হলে অনৈতিক আধিপত্য, চাঁদাবাজি, জমি নিয়ে অবৈধ বাণিজ্যের মতো বিষয়গুলো খর্ব হবে। তিনি বলেন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর যে দুটি দল সক্রিয় রয়েছে, তাদের মধ্যেই মূলত সমস্যা হচ্ছে। একে অন্যের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে পুরো পাহাড়ি অঞ্চলে।
একের পর এক খুনের ঘটনায় পাহাড়ের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আতংক বিরাজ করছে পুরো পাহাড়ি এলাকা জুড়ে।
বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ড নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী বহরে গুলির ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কারা এবং কেনো ঘটনা ঘটলো সে বিষয়ে এখনো জানা যায়নি। নিরাপত্তায় গাফিলতি ছিল না। দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ বুঝে এ হামলা ঘটিয়েছে। পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় আজ বুধবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখা।
রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে ৭ জনকে হত্যা, বিলাইছড়িতে আওয়ামী লীগ নেতা সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গাকে হত্যা ও বাসন্তি চাকমাকে সংসদ সদস্য পদ থেকে অপসারণের দাবিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাঙালি ছাত্র পরিষদের জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. রবিউল হোসেন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা যায়।
এতে বলা হয়, যৌথ অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টা আলিন্টমেটাম দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রশাসনের কোনো সাড়া না পাওয়ায় হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এদিকে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচনে দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে ব্রাশফায়ারে হতাহতের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছেন বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন তিনি।
স্থানীয় সরকার বিভাগে পরিচালক দীপক চক্রবর্ত্তীকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সদস্যসচিব এবং পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি, বিজিবির মেজর পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা, পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের যুগ্ম সচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা, রাঙামাটি জেলা পরিষদ ও আনসার-ভিডিপির প্রতিনিধিকে সদস্য করা হয়েছে। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে খাগড়াছড়ি সেনাবাহিনীর রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই নৃশংস ঘটনা খুবই দুঃখজনক। পাহাড়ে দ্রুত চিরুনি অভিযান চালানো হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যৌথবাহিনী কাজ করবে। পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িতদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। তিনি গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের একথা বলেন।

নিহতদের লাশ
হস্তান্তর, সর্বত্র
শোকের ছায়া
এম. কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি
বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী কাজ শেষে উপজেলা সদরে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের অতর্কিত গুলিতে নিহত ৭ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই ঘটনায় আহত ১৮ জন এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছে। প্রিয় স্বজনের লাশ দেখেই উপস্থিত পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে শোকের মাতম শুরু হয়। তাদের কান্নার শব্দে আশেপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে নিহতদের লাশ গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে নিজ নিজ পরিবারে হস্তান্তরের তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমএ মঞ্জুর।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, স্বজনদের কাছে হস্তান্তরকৃত ব্যক্তিরা হলেন বাঘাইছড়ি কাচালং বাজারের মো. সেলিম উদ্দিনের ছেলে আনসার ভিডিপি সদস্য মো. আল আমিন (১৮), বাঘাইছড়ির করেঙ্গাতলি গ্রামের মিহির কান্তি দত্ত (৩৮), বাঘাইছড়ির পশ্চিম লাইলাঘোনা গ্রামের মজিবর রহমানের স্ত্রী আনসার-ভিডিপি সদস্য বিলকিছ আক্তার (৪০), বাঘাইছড়ির কাচালং বাজার গ্রামের তপসি’র স্ত্রী আনসার ভিডিপি সদস্য জাহানারা বেগম (৩৫), বাঘাইছড়ির কাচালং বাজার কলোনির মরহুম আবু তাহেরের ছেলে এবং কিশলয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আমির হোসেন (৩৮), বাঘাইছড়ির পূর্ব লাইলাঘোনা গ্রামের মরহুম আবদুল কুদ্দুস মেম্বারের ছেলে এবং নিউ লাইলাঘোনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু তৈয়ব (৪২), দিঘীনালার মেরুং এর তপতি চাকমার ছেলে মিন্টু চাকমা (৩৪)।
এই ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরা হলেন বেটলিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ফুল কুমারী চাকমা, মো. জাফর, মো. মিজানুর, নিরু বিকাশ চাকমা, মো. সাদ্দাম, মাহবুব ও মামুন। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি সেনা রিজিওনের জিটুআই মেজর রকিবুল ইসলাম।
এদিকে ঘটনার রাতে বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা ৮ জনকে গতকাল মঙ্গলবার সকালে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে ৪ পুলিশ সদস্য হলেন এসআই রজব আলী, এএসআই বিল্লাল, সিপাহী আলীম ও এনামুল। অন্য আহতরা হলেন শিজক কলেজের প্রভাষক (যিনি কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন) আবদুল হান্নান আরব, কৃষি কর্মকর্তা বদিউল আলম, শিক্ষক মো. মাহবুব, মো. জাফর আলী, আনসার-ভিডিপি সদস্য মো. কবির হোসেন, মো. হাবিবুর রহমান, মো. মামুন, শারমিন আক্তার, কহিনুর বেগম, কাঞ্চন, নিরু চাকমা, সোহেল চাকমা, স্ট্রং চাকমা ও গাড়ির হেলপার মো. সাদ্দাম।
সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া এবং বাঁ আঙ্গুলে গুলি লাগা আনসার-ভিডিপি সদস্য মো. হাবিবুর রহমান জানান, ওই সময় ফেরার পথে পাহাড়ের ওপর থেকে এবং দুই পাশ থেকে অতর্কিতকভাবে ঝড়ের মতো গুলি বর্ষণ করা হয়। এতে সবাই গুলিবিদ্ধ হওয়ায় আমাদের হাতে অস্ত্র থাকলেও পাল্টা জবাব দেয়ার কোনো সুযোগ হয়নি। আমার বাঁ আঙ্গুলে গুলি লাগে। ভাগ্যের ফলে বেঁচে গেছি হয়তো।
অন্যদিকে ১৫ ঘন্টার ব্যবধানে গতকাল মঙ্গলবার সকালে আরেক উপজেলা বিলাইছড়িতে গুলি করে খুন করা হয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে। এসব ঘটনায় আঞ্চলিক দল জেএসএস ও ইউপিডিএফকে দায়ী করছেন কোনো কোনো মহল। ফলে এসব নৃশংস ঘটনায় জনমনে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা। ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি করেছেন বিভিন্ন মহল।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ তৎপরতায় রয়েছে নিরাপত্তাবাহিনী। সদরসহ জেলাজুড়ে জোরদার করা হয়েছে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঘটনাস্থলসহ আশেপাশের এলাকাজুড়ে চলছে যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। তবে এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি। ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে এবং ঘটনার আসল রহস্য উদ্ঘাটনে জোরালো তৎপরতা চলছে বলে জানান পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির।
উল্লেখ্য, গত সোমবার দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত বাঘাাইছড়ি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দায়িত্ব পালন শেষে দু’টি জীপগাড়িতে করে নির্বাচনী সরঞ্জামসহ সদরে ফেরার পথে উপজেলার ৯ কিলোমিটার অতিক্রম করার পর গাড়িটির ওপর এলোপাতারি গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই ৬ জনের মৃত্যু হয়। পরে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়ার পথে আরেকজন মারা যান। নিহতরা সবাই নির্বাচনী কাজে জড়িত ছিলেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরা :
গতকাল মঙ্গলবার সকালে বাঘাইছড়ির ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছেন খাগড়াছড়ি রিজিওন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক, পুলিশের চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি গোলাম ফারুক, রাঙামাটি জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ, পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবিরসহ সামরিক, বেসামরিক ও সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। পরিদর্শনকালে বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন তারা। ওই সময় তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদারের আশ্বাস দিয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে দুপুর দেড়টার দিকে বাঘাইছড়ি উপজেলা মিলনায়তনে মতবিনিময় সভা করা হয়। এসময় বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাদিম সারোওয়ার, বাঘাইছড়ি পৌরসভার মেয়র জাফর আলী খানসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় নিহতদের পরিবারপ্রতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে নগদ ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের পরিবার প্রতি ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
সভায় স্থানীয়রা ঘটনাস্থল ‘৯ কিলোমিটার’ নামক স্থানে সেনাবাহিনীর একটি স্থায়ী ক্যাম্প করার জোর দাবি জানান। এছাড়া হতাহতদের পরিবারদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ বা সহায়তা দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত ডিআইজি গোলাম ফারুক ওই স্থানে একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন এবং নিহত পরিবারের সদস্যদের থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে ১ জন করে সরকারি চাকুরি দেয়ার আশ্বাস দেন।
এদিকে ঘটনার ব্যাপারে জেএসএস (মূল) এবং ইউপিডিএফকে দায়ী করেছেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতারা। এ ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস বইছে। কিন্তু কিছু মহল তা নস্যাৎ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সোমবার বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে গুলি করে এবং পরদিন বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যার ঘটনার উদ্দেশ্য তার মূল কারণ। তিনি এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে দোষীদের বের করে আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান।
রাঙামাটির সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেন, এ কারণেই আমরা পার্বত্য এলাকা হতে সব ধরনের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। কারণ তারা বারবার এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এসব ঘটনায় জড়িত এখানকার আঞ্চলিক দলগুলো। তিনি অবিলম্বে বাঘাইছড়ি ও বিলাইছড়ির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনের আওতায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর বলেন, ওই দু’টি ঘটনায় আঞ্চলিক দল জেএসএস ও ইউপিডিএফ জড়িত। অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার (আজ) সকালে রাঙামাটিতে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাঘাইছড়ি উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের শীর্ষ নেতা সুদর্শন চাকমা বলেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে গুলি করে হত্যার ঘটনায় গোটা বাঘাইছড়ি এলাকায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আমি নিজেও আতঙ্কে। এ ঘটনায় জেএসএস (মূল) এবং ইউপিডিএফ (মূল) জড়িত। অবিলম্বে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া না হলে বারবার এ ধরনের হত্যাকান্ড ঘটানোর সাহস পাবে সন্ত্রাসীরা।
ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) কেন্দ্রীয় নেতা মাইকেল চাকমা বলেন, বাঘাইছড়ির ঘটনা নির্বাচনী সহিংসতা। কিন্তু সেখানে আমাদের কোনো প্রার্থী ছিল না। কাজেই আমাদেরকে দায়ী করা সম্পূর্ণ অমূলক, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ওই ঘটনায় আমাদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রশ্নই ওঠে না। ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে তা অত্যন্ত ঘৃন্যতম ও নিন্দনীয়। তাই যারা-ই এই ঘটনা ঘটাক, সঠিক তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করছি আমরা।
বিলাইছড়ির সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যাসহ এসব ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের করা অভিযোগ অস্বীকার করে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নীলোৎপল খীসা বলেন, কিছু ঘটনা ঘটলে আমাদের ওপর দোষ চাপানো আওয়ামী লীগের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের কোনো ঘটনায় আমাদের কেউ জড়িত নেই। আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। মূলত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করে তা অন্য খাতে প্রবাহিত করতে আওয়ামী লীগের লোকজন জেএসএস’এর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ষড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যা-বানোয়াট অভিযোগ করে আসছে।

বেঁচে ফেরা ইয়াসমিনের বর্ণনা
উঁচু পাহাড় থেকে বৃষ্টির মতো গুলি

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, পাহাড়ের কোলে বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সারাদিন ভোট হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। কিন্তু সন্ধ্যায় ভোটের সরঞ্জাম নিয়ে চাঁদের গাড়িতে করে ফেরার পথে পাশের উঁচু পাহাড় থেকে ছুটে এল গুলি।
রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি-দিঘিনালা সড়কের নয় মাইল এলাকায় সোমবার সন্ধ্যার ওই হামলা কেড়ে নিয়েছে দুই
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ সাতজনের প্রাণ। সবুজ পাহাড়ে এই সহিংসতা নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো বাংলাদেশকে।
দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বিবাদমান পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে হানাহানি আর হত্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু রাস্তার ওপর অ্যামবুশ করে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের এভাবে হত্যার ঘটনা নজিরবিহীন।
দেশের বিভিন্ন স্থানের ১১৫টি উপজেলার সঙ্গে বাঘাইছড়ি উপজেলাতেও সোমবার ভোট হয়। তবে পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএস সমর্থিত প্রার্থীরা কারচুপির অভিযোগ এনে সকালেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। এরপর সন্ধ্যায় ঘটে ওই হত্যাকান্ড।
সেখানে ঠিক কী ঘটেছিল, তার একটি বর্ণনা পাওয়া যায় বাঘাইছড়ি উপজেলার মুসলিম ব্লক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তারের কথায়। নিজে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলেও চোখের সামনে সহকর্মীদের খুন হতে দেখার পর স্বাভাবিক হতে পারছেন না তিনি। খবর বিডিনিউজের
পোলিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে ইয়াসমিনকে পাঠানো হয়েছিল বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। দুর্গম পাহাড়ে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রোববার দুপুরেই তারা কেন্দ্রে পৌঁছে যান। সোমবার সকালে নির্ধারিত সময়েই ভোট শুরু হয়।
পুরোটা সময় বেশ ভালোভাবে সব হচ্ছিল। ভোটাররা এসে ভোট দিচ্ছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল ভোটগ্রহণ। কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হল। এরপর আমরা গণনাও শেষ করলাম।
ওই কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন জনসংহতি সমিতির এমএন লারমা অনুসারী অংশের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা। তার প্রতীক ছিল ঘোড়া।
সুদর্শনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমার অনুসারী অংশের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের গত মেয়াদের চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা ভোটের সকালেই জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে তার প্রতীক ছিল দোয়াত কলম।
ইয়াসমিন জানান, ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা প্রায় ২৫ জন গাদাগাদি করে একটি চাঁদের গাড়িতে উঠে রওনা হন বাঘাইছড়ির উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ছাড়াও পুলিশ ও ভিডিপি সদস্যরা ছিলেন ওই গাড়িতে।
তাদের গাড়ি যখন বাঘাইহাট পৌঁছায়, তখন সেখানে অপেক্ষা করছিল আরও দুটো চাঁদের গাড়ি। সাজেক ইউনিয়নের কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শেষে ভোটগ্রহণকর্মীরা ওই দুটি গাড়িতে করে তাদের সরঞ্জাম নিয়ে ফিরছিলেন।
আমাদের তিনটি গাড়ি তখন একসঙ্গে বাঘাইছড়ির দিকে রওনা করল। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছিল বিজিবির একটা টহল গাড়ি। চারটি গাড়ির বহর, সবার সামনে বিজিবির গাড়ি। তার পেছনেই ছিল আমাদের গাড়িটা।
ইয়াসমিন বলেন, তাদের গাড়িগুলো নয় মাইল এলাকায় পৌঁছানোমাত্র পাশের উঁচু পাহাড় থেকে পেছনের তিনটি গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত গুলি শুরু হয়।
কিন্তু আমাদের গাড়িগুলো থামেনি। গুলি উপেক্ষা করে চালকরা গাড়ি টেনে চালিয়ে সরাসরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসে। এ এক বীভৎস অভিজ্ঞতা। কান্না, চিৎকার, রক্ত…।
রক্তাক্ত চাঁদের গাড়ি থেকে নামানোর পর একে একে মারা ছয়জনের মৃত্যু হয়। রাতে চট্টগ্রামের হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আরও একজন।
নিহতরা হলেন- পোলিং অফিসার আমির হোসেন ও আবু তৈয়ব, আনসার-ভিডিপি সদস্য মিহির দত্ত, আল আমিন, বিলকিস আক্তার ও জাহানারা বেগম এবং মন্টু চাকমা।
সারা দিন আমরা একসাথে কাজ করলাম, সেই মানুষগুলো একের পর এক, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইয়াসমিন আক্তার।
একটু সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ পরে তিনি বলেন, এটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ভাই, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। আমার সহকর্মী আমির হোসেন, তৈয়ব আলী মারা গেছে। আমার বান্ধবী কাঞ্চি, বড় ভাই বদিউজ্জামান, ওরা গুরুতর আহত। হতাহত সবাইতো আমার কমবেশি চেনা। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেন তাদের মরতে হল?
কবে বন্ধ হবে এইসব বর্বরতা। আর কত লাশ পড়বে পাহাড়ে? এর মধ্যে কীভাবে আমরা সরকারি দায়িত্ব পালন করব?
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইয়াসমিন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচন কিংবা যে কোনো সরকারি দায়িত্ব পালন করা সবসময়ই কঠিন। আমাদেরকে নানা ধরনের চাপে থাকতেই হয়। কিন্তু এরকম ভয়াবহ বর্বরতা ভবিষ্যতে আমাদের আরও বেশি চাপে ফেলবে। আমি অনুরোধ করি, আপনি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
মামলা হয়নি : বাঘাইছড়ির ঘঢ়টনায় গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি থানায়; পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারও করেনি।
বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিহত ছয়জনের লাশ এখনো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে আছে হাসপাতালের পরিবেশ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছুফি উল্লাহ জানান, পোস্টমর্টেম করার জন্য মৃতদেহগুলো খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
একের পর এক ঘটনায় আমরা বেশ চাপের মধ্যে আছি। এর মধ্যে বিলাইছড়িতে আরেকটি হত্যাকান্ড ঘটে গেছে। দুর্গম এলাকা আর বাস্তবতার কারণেই দ্রুত কিছু করা কঠিন হচ্ছে।