আবরার ফাহাদের হত্যা রুগ্ন সমাজের কুৎসিত প্রকাশ

118

গত ৬অক্টোবর‘১৯ রবিবার রাতে এই বর্বর নৃশংস হত্যাকান্ডটি ঘটে-জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটে। ৭/৮জন মেধাবী ছাত্র অপর মেধাবী ছাত্র আবরারকে নির্মমভাবে দুই দফায় পিটিয়ে হত্যা করে। সে তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিষয়ে ২য় বর্ষের ছাত্র। অপরাধ ভিন্ন মত পোষণ করা। সভ্য সমাজে মান যাচাইয়ের অন্যতম সূচক হল বাকস্বাধীনতা, ভিন্ন মত পোষণ করা। আত্মশুদ্ধির জন্য অগ্রগতির জন্য সমালোচনা ও ভিন্নমত হল পাথেয়। অন্য দিকে সমাজ আধুনিকায়ন ও প্রগতির পথে বিকশিত হতে বড় প্রতিবন্ধকতা হল সে সমাজ চরিত্রের অসহিষ্ণুতা। স্বাধীনতার এত বছর পর এসেও সেই অভিশপ্ত অসহিষ্ণুতা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারলাম না। আবরার হত্যার মধ্যে দিয়ে তা আবারও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল-শুধু মস্তিষ্ক ব্যবহার করে মেধাবী হলে হয় না, হৃদয়বান হওযার ব্যবস্থা থাকাটাও জরুরি। দূষিত বিনষ্ট সমাজ ভূমিতে বৃক্ষের সমাহারে বনাঞ্চল গড়ে উঠে নাÑ গড়ে উঠে লতা গুল্ম নিয়ে শ্বাপদসংকুল ঝোঁপ-ঝাড়। যা সংকীর্ণতা, মিথ্যা অহমিকা, অজ্ঞতা, কুযুক্তি, বদ্ধচিন্তা, রক্ষণশীলতা ইত্যাদির অন্ধকারে ডুবে থাকে।
আমরা মেধার চাকচিক্যে সব ভুলে যাই শিক্ষার উদ্দেশ্য-নৈতিক মূল্যবোধে মন-মননের বিকাশের কথা এবং বুদ্ধির বিকাশের কথা যা প্রান্তহীন অনির্ধারিত। না হয় জাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা (?) কিভাবে এমন নিষ্ঠুর নির্মম হত্যাকান্ড চালাতে পারে। এই দায় কি শুধু তাদের! খবরটা মন হল, শ্রবন ইন্দ্রিয় কান দিয়ে নয়, গরম ছুরিরমত ছ্যাঁৎ করে বুকের ভিতর দিয়ে ডুকে গেল। টিভির সামনে আমরা পরিবারের সবাই চুপচাপ বসে থাকি- কারো মুখ দিয়ে কথা বাহির হয়নি।


পেশাদারিত্বে উৎকর্ষ লাভের জন্য বুয়েটের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। তাতে জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবীরা পড়ার সুযোগ পায়। তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল-সেই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতায় আমাদের বর্তমানকে চোখে পড়ে না- বর্তমান অবহেলিত থেকে যায়। এখানে সংকট তৈরি হয়। সংকট তৈরি করি আমরাওÑ অভিভাবকরা , শিক্ষকরা। ভবিষ্যৎ স্বপ্নে আমরা এতই মশগুল থাকি যে, সন্তান বেড়ে উঠার পথে তার দৈহিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক ও আবেগিক সুস্থতার কথা ভাবতে পারি না। বরং ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণে বর্তমানকে আমরা হত্যা করি। আশা-প্রত্যাশার স্বপ্নগুলো পূরণে সন্তানকে রাত-দিন পড়ার নির্যাতনে রাখি। সকাল বিকাল ৩/৪ টি প্রাইভেটে, রাতে বিশেষ কোচিং-এ, দুপুরে মডেল টেস্টে ব্যস্ত রাখি। তাতে সে হাঁপিয়ে উঠে। সে তো কোন খানে ছাত্র জীবনের আনন্দ খোঁজে পায় না। তাকে সতীদাহের ডামাঢোলে ডুবিয়ে রাখি-তার হৃদয়ের কান্না আমরা শুনতে পাই না। মননশীলতার জন্য, তা ক্ষয়ে না যাবার জন্য আনন্দ প্রয়োজন। নিরানন্দ জীবনে মননশীলতা ক্ষয় হয়ে যায়। সেই মননশীলে ক্ষয় হওয়া সন্তান মেধাবী হতে পারে রোবটের মত-কিন্তু নৈতিকতায় হৃদয়বান হতে পারে না। আর হৃদয়হীন মানুষ দিয়ে এ ধরনের হত্যাকান্ডই সম্ভব হয়।
তরুণদের মন-মানসিক ও আবেগিক শক্তি দিয়ে, প্রাণপ্রাচুর্য দিয়ে ভরা থাকে। তাই তাদের বিকাশের পথে মানবিক মূল্যবোধের নানা বিষয় থাক প্রয়োজন-সংবেদনশীল হয়ে উঠার জন্য, দায়িত্বশীল হয়ে উঠার জন্য। তাই শিক্ষাবিদরা সহপাঠক্রমিক বিষয়-শিল্পকলা চর্চার উপর এত জোর দেন। কবিতা আবৃত্তি, নাটক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সংগীত চর্চা, সাহিত্য, খেলাধুলা ইত্যাদির চর্চা ছাত্রজীবনে অপরিহার্যের কথা বলেন। আমরা তাতে কান দিই না। শুধু ব্যস্ত থাকি সন্তানের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নিয়ে। আমাদের সব সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সন্তানের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে। আর যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যতবেশি এ-প্লাস দিতে পারে বা যে শিক্ষক যতবেশি এ-প্লাস নিয়ে দিতে পারে তাকে আমরা উচ্চ মূল্য দিয়ে থাকি। এতে মননশীলতার চর্চা হয়ে উঠে না। আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
হত্যায় জড়িত এই মেধাবী ছাত্রদের অতীত ইতিহাস ঘাটলে হয়তো দেখা যাবে- তারা মেধাবী হওয়ার পিছনেই শুধু ছুটেছে।
নিরানন্দ ও বিবর্ণ ছাত্র জীবনের ভিতর দিয়ে শুধু পরীক্ষার ফলাফলই তাদেরকে, তাদের অভিভাবকদেরকে সুখ দুঃখ দিয়েছে। যার জন্য উচ্চ নম্বরের প্রত্যাশায় ছাত্ররা নিজেরা যেমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছে-ডানে বায়ে কিছু দেখার, ভাবাব সুযোগ হয়নি-তেমনি অভিভাবকরাও ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় বর্তমানে লেখাপড়ায় ব্যস্ত রাখার জন্য দিয়েছে অতিরিক্ত চাপ, করেছে অতিরিক্ত নিষ্পেষন, ফলে সেই সব ছাত্রদের মধ্যে মননশীলতার বিকাশের সুযোগ ঘটেনি। ক্ষয় হয়ে গেছে তাদের হৃদয় চেতনা। কারণ চাপে-তাপে নিষ্পেষনে আর যাই হোক মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা, সংবেদনশীলতা, সংগ্রামশীলতা ইত্যাদি মানসিক ও আবেগিক বিষয়গুলোর জীবনমুখী, সমাজমুখী বিকাশ ঘটে না। তাতে তাদের মানসিক প্রচন্ড সঞ্চিত আবেগ ভিন্নখাতে প্রাবাহিত হয়ে যায়। সেই ভিন্ন খাতে প্রবাহের কারণে কেউ ঐশী হয়ে বাবা-মাকে হত্যা করে, কেউ জঙ্গি হয়ে আত্মঘাতি বোমা বহন করে। আর কেউ এমন জঘন্য হত্যাকান্ড ঘটায়।
অসহিষ্ণুতায় কত নিচে নামতে পারলে একই হোস্টেলে থাক-যার সাথে সকাল বিকাল ক্যান্টিনে, ক্যাফেটেরিয়ায় দেখা হয়, আলাপ হয় তাকে ভিন্ন মত পোষণ করায় নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে। তাও আবার সদলবলে। আমরা অভিভাবকরা আমাদের সন্তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন উৎকন্ঠিত ছিলাম। এই হত্যাকান্ডে আমরা আতংকিত হয়ে পড়ি। মেধাবীদের এই মানসিক অসুস্থতা ও বিকৃতির জন্য গোটা সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী। তাদেরকে হাতকড়া পরায়ে শাস্তি দিলেই শুধু হবে না। এই অসুস্থতা ও বিকৃতির পচনের শিখড় কত গভীরে বিস্তৃত তাও খতিয়ে দেখতে হবে। তা নিরাময়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদীর নানা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। না হয় ভবিষ্যতে আরো জঘন্য ও বিভৎস ঘটনা সমাজকে গ্রাস করবে। কিন্তু এই কাজ শুরু করবে কারা। ছাত্রদের মনন বিকাশের জন্য, সংবেদনশীল হয়ে উঠার জন্য, দায়িত্বশীল হয়ে উঠার জন্য তো শিক্ষাবান্ধব সংস্কৃতির প্রয়োজন। সেই দরকারি কাজটি করার প্রচেষ্টা তো দৃশ্যমান নয়। আস্বস্ত হই কি করে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধের জন্য আমাদের তো ধারাবাহিক জোরালো কর্মসূচি ও অনুশীলনের ক্ষেত্র দেওয়া প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন মিটাতে এগিয়ে আসবে কারা। যারা তা পারেন বিশেষ করে রাজনীতিকরা, সমাজ নিয়ন্ত্রকরা যতটা ছাত্ররাজনীতিতে আগ্রহী হন ততটা শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে মননশীল চর্চায় আগ্রহী হতে দেখা যায় না। সৃজনে বিমুখ, অর্থ লিপ্সুরা যদি শিক্ষাঙ্গনে জড়িয়ে যায় তখন এ ধরনের কাজে আগ্রহ থাকার কথা না। তাদের অযোগ্যতার, অদক্ষতার আবর্জনায় শিক্ষাঙ্গন দূষিত হয়ে পড়ে। তবে বোধের যুক্তিতে এটাই সত্য যেসব কিছুর উৎপত্তি আমাদের চারদিকের ক্রিয়াশীল কার্যক্রম থেকে। সেই কাযক্রমে যদি টেন্ডারবাজি, ঘুষবাণিজ্য, অনৈতিক কাজের প্রকটতা বিরাজ করে তাহলে মানবিক হওয়ার বিষয়টি থাকতে পারে না। ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, যেমন পড়েছে আবরার।
আমাদের ছাত্রদের জন্য আনন্দপূর্ণ ছাত্রজীবন চাই। ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছাত্রদের বর্তমানকে নিষ্পেষিত হতে দেওয়া যায় না। তার জন্য সামাজিকভাবে আত্মসচেতন হয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করা বেশি জরুরি। অন্য দিকে রাজনৈতিক সদিচ্ছারও কার্যকর করা দরকার হয়। মানুষতো কার্যকারনের যুক্তিপাত করার ক্ষমতা রাখে। এই কথায় সেই গল্পটার কথা স্বরণে আসে। এক কুখ্যাত ডাকাতকে জজসাহেব খুনের দায়ে ফাঁসির আদেশ দিলে তখন জজসাহেবকে তার অভিভাবককে দয়া করে তার মুখোমুখী করার আবেদন জানায়। জজসাহেব তা করলে সেই কুখ্যাত ডাকাত তার অভিভাবকের নাকমুখ কামড়িয়ে ধরে। পরে কারণ জানতে চাইলে সেই ডাকাত বলে ছোটকালে কত মারামারি, চুরিচামারি করেছি। তা যদি অভিভাবকের দায়িত্ব হিসাবে আমাকে সংশোধন করে দিত তাহলে আজ এই ডাকাত হয়ে উঠতাম না, খুনি হতাম না। তাই বীজতলার উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। যাতে হৃষ্টপুষ্ট সাবলীল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চারা গাছ বৃক্ষ উপযোগী হয়ে উঠতে পারে।
বেশির ভাগ ছাত্র তো পায়ে পিঁপড়া না মাড়িয়ে পথ চলে, বন্ধুর চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে ঝড়ে ভিজে, রোদে পুড়ে। পরীক্ষার নোটপত্র দিয়ে আপদকালিন অর্থ দিয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। এই ঘটনায় তাদের কি হবে। তাদের মানসিকতা ভেঙ্গে না পড়ার জন্য জীবনের অনিশ্চয়তা বোধ না করার জন্য এই হত্যাকান্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাবান্ধব সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করা বেশি জরুরি। তা না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সংকীর্ণতা গোষ্ঠিবদ্ধতা, মিথ্যা অহমিকা, বিশ্বজনীন মূল্যবোধের প্রতিবন্ধকতা, রক্ষনশীলতা ইত্যাদির কালো থাবা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা যাবে না। আর সেই সব দূর করতে পারলে মেধাবীরা পাশবিক হয়ে উঠবে না, অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে না। তাতে সমাজকে আধুনিকায়ন করার প্রতিবন্ধতা থাকবে না। সেই বাধা দূর করতে বস্তুগত উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি, কতটুকু জরুরি তা জানান দিল আবরার-এর হত্যাকান্ড।

লেখক : অধ্যক্ষ, প্রাবন্ধিক