আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ

150

নুরুল ইসলাম

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সংগ্রাহক সুচক্রদন্ডী নিবাসী মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। উভয় বাংলার গবেষণাধর্মী মুসলিম বাংলা সাহিত্যের আগ্রদূত হিসেবে যাঁর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অবদান শুধুমাত্র প্রাচীন পুঁথিপত্র সংরক্ষণের জন্য নয়। তিনি বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে গৌরবোজ্জ্বল অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত পুঁথি গবেষক ও সংগ্রাহক মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ পটিয়া থানার সুচক্রদন্ডী গ্রামে ১৮৭১ খ্রিঃ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নুরুউদ্দীন ও মাতার নাম মিশ্রীজান। মাতৃগর্ভে ছয়মাস বয়: ক্রমকালে তাঁর পিতৃ বিয়োগ ঘটে। জন্মের পর পিতামহ মোঃ নবী চৌধুরী, পিতৃব্য আইন উদ্দীনের স্নেহে ও যত্নে প্রতিপালিত হয়। তিনি ১৮৯৩ সালে পটিয়া হাই স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার পূর্বেই তাঁকে স্বাস্থ্যগত কারণে পড়ালেখা ছাড়তে হয়। তবুও তিনি সংস্কৃত ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করতে সক্ষম হন। এই সময়ে আর্থিক দুরবস্থার কারণে তিনি শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত হন। এভাবে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি পুরো কর্মজীবন কখনো শিক্ষকতা, কখনো সিভিল কোর্ট বা শিক্ষা অফিসে কেরানীর কাজ করে কাটান। ১৮৯৫ খ্রিঃ চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি এ সময় সীতাকুন্ড মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের অস্থায়ী পদ গ্রহণ করেন। তিনি ১৮৯৬ খ্রিঃ চট্টগ্রাম প্রথম সাব জজ আদালতে শিক্ষা নবীস পদে যোগদান করেন। ১৮৯৯ খ্রিঃ আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে চাকুরী করেন। ১৯০৬ খ্রিঃ চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্কুলে ইন্সপেক্টরের অফিসে কেরানী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
সাহিত্য বিশারদের বাড়ীতে আজ আর সে শ্রী নেই। সাহিত্যপ্রেমিক তথ্যানুসন্ধানী মানুষ আজ কাল তাঁর বাড়ীতে গিয়ে মনের ক্ষিদে নিয়ে ফিরে আসে, কারণ বাড়ীটিতে আজ আর এমন কেউ নেই যে, প্রাণের টানে ছুটে আমাদের প্রাণ তৃষ্ণা মিঠাবে। সাহিত্য বিশারদের জীবদ্দশায় এ বাড়ীতে আগমন ঘটেছিল ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক সহ দেশের অনেক নামজাদা ব্যক্তিত্বের। অমর গবেষক শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলে বাড়িটির সর্ব প্রকার কর্ম কোলাহল থেকে যায়। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। ছিল একটি মাত্র মেয়ে। তার নাম আলতাফুন নেছা। তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামস্থ পাঁচলাইশে। সেও আজ বেঁচে নেই। অপুত্রক হওয়ার কারণে সাহিত্য বিশারদের চাচাতো ভাইপো ড. আহম্মদ শরীফকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন।
বাংলা সাহিত্য ভাÐার যাঁর কাছে ঋণী, যারা পল্লীর মানুষকে নিয়ে সাহিত্য সাধনার কথা ভাবেন তারা যাদের কাছে ঋণী সমাজের উত্তম সেবার আদর্শ স্থাপনে আগ্রহীদের কাছে যারা জনহিতোষী দিক দর্শন তাদের মতই সাধক পুরুষ মরহুম আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ।
অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি পুঁথি সংগ্রহের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কষ্টার্জিত অর্থকে নিঃশেষ করতে থাকেন সাধনার পিছনে। তিনি যে শুধু পুঁথি সংগ্রহ করে সুনাম অর্জন করেছেন তা নয়। তিনি আড়াই সহস্রাধিক পুঁথির পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেন এবং ছয় শতাধিক গবেষণামূলক মৌলিক প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর সম্পাদিত বাংলা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড), নরোত্তম ঠাকুরের “রাধিকার মানভঙ্গ”, কবি বল্লভের সত্য নারায়ণের পুঁথি, দ্বিজরতি দেবের মৃগযুদ্ধ, পুঁথি দ্বিজ মাধবের গঙ্গামঙ্গল, আলী রাজার জ্ঞান সাগর, বাসুদেব ঘোষের শ্রী গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস, মুক্তারাম সেনের সারদা মঙ্গল, শেখ ফয়জুল্লার গৌরক্ষ বিজয়, প্রভৃতি কলিকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ১৯৩৬ সালে ড. এনামুল হকের সহযোগিতায় আরাফান রাজ সভার বাংলা সাহিত্য গবেষণা গ্রন্থটি রচনা করেন সাহিত্য বিশারদ। ১৯৬৪ সালে তাঁর রচিত ‘ইসলামাবাদ’ নামক ইতিহাস গ্রন্থটি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশ হয়। সাহিত্য কর্ম ও গবেষণায় তাঁর এ অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য চট্টগ্রামের সাহিত্য বোদ্ধাগণ তাকে সাহিত্য বিশারদ ও নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজ তাকে সাহিত্য সাগর উপাধিতে ভূষিত করেন।
আবদুল করিম স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের ও পটিয়া ঋণ সালিশী বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ১৯০৩ খ্রি: সদস্য ও ১৯৩৬ খ্রি: সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। আবদুল করিম ১৯১৮ খ্রি: চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর জ্ঞান ও অধ্যবসায়ে মুগ্ধ হয়ে তাকে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের এন্ট্রাস ও বি.এ. বাংলা পরীক্ষক নিযুক্ত করেন। ১৯৫১ খ্রি: তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের একটি পত্রের প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
প্রসঙ্গক্রমে বর্তমানে যুগে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিধিতে সাহিত্য বিশারদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারছিনা। উচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কোন মহল থেকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থাও লক্ষণীয় নয়। চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মন্দিরের বিপরীতে একটি সড়ক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের নামে করা হয়েছে। পটিয়ায় মুন্সেফ বাজার থেকে উত্তরে তাঁর নামে একটি সড়ক নাম করণ করা হয়েছে।
চেয়ারম্যান মো: ছৈয়দ প্রতিষ্ঠিত ‘সাহিত্য বিশারদ স্মৃতি সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। পটিয়ার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সামাজিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মৃত্যু দিবস পালন করে থাকে। এ সাহিত্য সাধক তাঁর বিশাল কর্মময় জীবন অতিবাহিত করে ১৯৫৩ খ্রি: ৩০ সেপ্টেম্বর পরলোক গমন করেন। বাড়ির পাশেই পারিবারিক কবরস্থানে প্রতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
তথ্য সূত্র: এস.এম.এ.কে. জাহাঙ্গীর কর্তৃক প্রকাশিত পটিয়া’র ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থ।

লেখক : সাবেক সভাপতি, পটিয়া প্রেস ক্লাব