আনন্দময় হোক শিশুর শিক্ষার জগৎ গড়ে উঠুক আত্মবিশ্বাস

277

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম স্তর প্রাথমিক শিক্ষা। জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকালকে শিক্ষা জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা বলা হয়। জাতীয় জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ শিক্ষা স্তরের মূল ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে একটি দেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর করা সম্ভব। তাই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য জাতিসত্তা, আর্থ-সামাজিক, শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতা এবং ভৌগলিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। শিক্ষার এই স্তর পরবর্তী সকল শিক্ষা স্তরর ভিত্তি সৃষ্টি করে বলে যথাযথ মানসম্পন্ন-উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন করা এবং তাদের দেশাত্ববোধ, বিজ্ঞান মনষ্কতা এবং সৃজনশীলতা ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করাই প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে ১৩টি উদ্দেশ্য এবং ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিসহ গণ্য করলে একটি শিশু নির্ধারিত ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনের জন্য ছয়টি বছর সময় পায়। সময়টি যথেষ্ঠ। তবে মন্ত্রনালয়, সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত আমরা যারা এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের কঠিন দায়িত্ব হাতে নিয়েছি তাঁদের সকলকে শিশুদের নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। গবেষণা করতে হবে। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে করে তুলতে হবে ‘শিশু স্বর্গ’। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই শিশুদের নিয়ে ভাবেন। বছরের প্রথম দিনেই সারাদেশে বই উৎসবের মাধ্যমে সকল শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেওয়া বর্তমান সরকারের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতভাগ শিশুকে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান ঝরে পড়া রোধে বর্তমান সরকারের এক সাহসী এবং কার্যকর প্রচেষ্টা। বিদ্যালয়কে শিশু বান্ধব করে সাজানোর জন্য আর্থিক বরাদ্দ প্রদান থেকে শুরু করে সকল প্রকার উদ্যোগ সরকার নিয়েছেন যা খুবই প্রশংসনীয়। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য বিদ্যালয়ের পরিবেশ আকর্ষনীয় ও আনন্দময় করে তোলা। শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলার সুব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের আগ্রহ, মমত্ববোধ ও সহানুভূতিশীল আচরণ এবং পরিচ্ছন্ন ভৌত পরিবেশসহ উল্লেখযোগ্য উপকরণের উন্নয়ন ঘটানো ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করণে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীর জন্য পৃথক মানসম্পন্ন টয়লেটের ব্যবস্থা করার কার্যক্রম সারাদেশে চলমান। বিদ্যালয়ে শিশুদের শারীরিক শান্তি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিশুর জন্য একটি সুন্দর সাজানো-গুছানো বিদ্যালয় নামক বাগান তৈরি করাই সরকারের লক্ষ্য। এই মহৎ কাজে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালী শিক্ষানুরাগীদের সহযোগিতাও প্রয়োজন। আবার শিশুর জন্য সাজানো বাগানের পরিচর্যায় নিয়োজিত মালী যিনি তিনি হলেন শিক্ষক। একজন শিক্ষক প্রথমেই শিশুর বন্ধু হবেন। মায়ের কিংবা বাবার হাত ধরে অপার বিষ্ময়বোধ, অসীম কৌতূহল, আনন্দবোধ ও অফুরন্ত উদ্যম এবং স্বপ্ন নিয়ে একটি শিশু প্রথম যেদিন বিদ্যালয় আঙিনায় প্রবেশ করবে সেদিনই শিক্ষক তাকে পরম মমতায় বরণ করে নেবেন। শিশু সম্পর্কে রেজিষ্টারে কোনো রেকর্ড রাখার প্রয়োজন হলে মা-বাবাকে প্রশ্ন করেই শিক্ষক তা সম্পন্ন করবেন। কোমলমতি শিশুকে কোনো প্রশ্নবানে বিদ্ধ করা যাবে না।
শিক্ষক হাত ধরে শিশুকে শ্রেণিকক্ষে নিয়ে যাবেন। পরিচয় করিয়ে দেবেন শ্রেণির অন্য বন্ধুদের সাথে। আনন্দ, হাসি, গান, ছড়া, কবিতা, ব্যায়াম, খেলাধুলা, ছবি আঁকা, অন্যের সাথে কথা বলা, অন্যের কথা শোনা এবং যোগাযোগ করা ইত্যাদির মধ্যদিয়ে শুরু হবে শিশুর শিক্ষা জীবন। এভাবে নিরাপদ, আনন্দঘন আর আকর্ষনীয় পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে শুরু করতে হবে শিশুর অ, আ, ক, খ এবং গণনা শেখা। শিশুকে শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো প্রকার শান্তি দেয়ার কথা শিক্ষককে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যেতে হবে।
শান্তি দিয়ে বা জোর করে শিশুকে কখনোই কিছু শেখানো সম্ভব হয় না। শিশুর মনে যদি আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করা যায়, বিদ্যালয় পরিবেশে সে যদি নিজেকে নিরাপদ মনে করে তবে তার বিকশিত হওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। এবার আসা যাক পরীক্ষার বিষয়ে। পরীক্ষা নামক বিষয়টি lower primary থেকে তুলে দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষক-অভিভাবক সকলের উচিত কেবলমাত্র পরীক্ষায় পাশ করানো কিংবা ১ম, ২য়, ৩য় হওয়ার দৌড়ে সামিল না হয়ে শিশুর সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করা।
আমরা সকল শিশুকে বাংলা ও ইংরেজি পঠন-লিখনে দক্ষ করে তুলবো, গণিতের প্রাথমিক চার নিয়ম পশখাবো এবং পাশাপাশি তাকে আচার-আচরণ, নীতি-নৈতিকতা, মানবতাবোধ, সৌহার্দ্য, সহানুভূতি, নান্দনিকতা, সৃজনশীলতা অর্জনে সহায়তা করবো। এর মাধ্যমে শিশুর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে কোনো প্রতিবন্ধকতা আর থাকবে না। আমাদের সঠিক পরিচর্যা পেলে প্রতিটি শিশুই হবে জাতির জনকের সোনার বাংলাদেশের সোনার মানুষ। দারিদধমুক্ত হয়ে উন্নত জাতি নিয়ে সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ। সবশেষে আমাদের প্রত্যাশা সঠিক পথে এগিয়ে যাক প্রাথমিক শিক্ষা। জয় হোক প্রাথমিক শিক্ষার। সফল হোক প্রাথমিক শিক্ষার সকল কর্মসূচী।লেখক : প্রধান শিক্ষক, ফিরিঙ্গীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।