আধ্যাত্মিক সাধক গুরু গোবিন্দ ঠাকুর

381

এই মহাবিশ্বে তথাগত গৌতম বুদ্ধের অমৃত বাণী অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী, করুণা, উপেক্ষাকে ধারণ করে ও চারি আর্য্যসত্য, অষ্টাক্সিগক মার্গ পথকে অবলম্বন করে যাঁরা এ দুলর্ভ মনুষ্য জীবনকে ধ্যান সাধনায় নিমগ্ন থেকে কুলষিত অন্ধকার সমাজকে আলোকিত করেছেন এবং দুঃখ-মুক্তির অন্বষণের মাধ্যমে পরম সুখ নির্বানকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছেন তাঁদের মধ্যে আধ্যাত্মিক সাধক, সিদ্দি পুরুষ গুরু গৌবিন্দ ঠাকুর অন্যতম। পরম পূর্জ্য গুরু গোবিন্দ ঠাকুর ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকের ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে আষাঢের ঘন বরিষণে বারিধারা স্নাত এই বাংলার গ্রামীণ জনপদে ধরাধামে আর্ভিভুত হন। বীর প্রসবিনী চট্টলার হাটহাজারী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গুর্মানমদ্দন বৌদ্ধ জনপদে ছিল তাঁর পৈত্রিক নিবাস। তাঁর পিতা ফেজারাম বড়ুয়া-এই গুমার্নমদ্দন গ্রাম থেকে ছুটে আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জোবরা গ্রামে। পিতা-মাতার তিন পুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় পুত্র। জন্মের পরে তাঁর নাম রেখেছিল গৌবিন্দ বড়ুয়া। জীবন জীবিকার তাগিদে তাঁর পিতা ফেজারাম বড়ুয়া জোবরা গ্রামে যখন স্বস্ত্রীক স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তখনি শৈশব ও কৈশোরে গোবিন্দ বড়ুয়া এই জোবরা গ্রামে বেড়ে ওঠেন। কৈশোরে বেড়ে ওঠার প্রাক্কালে তাঁর পিতার সংসারে অভাব গ্রস্থতার কারণে লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি তাঁর। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ত্রৈমাসিক বর্ষবাসের শেষের দিকে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর উপ-সম্পদা গুরু ছিলেন চাকমা ভিক্ষু রামমনি মহাস্থবির। ২১ বছর বয়সে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই প্রিয় গুরুভান্তের নিকট এ উপ-স¤পাদা লাভ করনে। গোবিন্দ শব্দের অর্থ জেনেই তাঁর গুরু কর্তৃক গোবিন্দ বড়–য়া থেকে গোবিন্দ শ্রামণ নাম রূপ ধারণ করেন। এভাবে গোবিন্দ শ্রামণ থেকে গোবিন্দ ভিক্ষু এবং পরবর্তীতে গুরু গোবিন্দ ঠাকুর নামে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কাছে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে জোবরা গ্রামে সুগত বিহার প্রতিষ্ঠিত হলেগোবিন্দ ভিক্ষু সেখানে অবস্থান করতেন না। তিনি ষড়র বাপের বিহারে তার গুরুর পথ অনুসরন করে শ্মশানচারী হয়ে দুঃখ-মুক্তির জন্য ধ্যান-সাধনায় নিবিষ্ট হলেন। মহা সতিপট্ঠান সূত্রের মর্ম সর্ম্পকে বিশেষ ভাবে অধিগত না হলেও তিনি শ্মশানিক ধুতাঙ্গ চর্চার মাধ্যমে লোকাত্তর মার্গ ধর্মের অমৃত স্বাদ পেয়েছিলেন। তিনি ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গৌরিক বসন পরিহিত হয়ে শীলবান ভিক্ষু জীবন অতিবাহিত করেন। সুদীর্ঘ ২৬ বছরের ভিক্ষু জীবন ধ্যান-সাধনায় কেটেছিল তাঁর। বিশেষ করে তাঁর ধ্যান-সাধনার বিষয় ছিল শমথ ভাবনা। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, গোবিন্দ ভিক্ষুর আটাশ বছর বয়োপূর্তিতে স্বর্ণালী যৌবনের সকল বীর্য শক্তি, পঞ্চ নিবারণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ধ্যানানুশীলনে স্বীয় আধ্যত্মিক অনুভূতির উন্নতি সাধনে খুবই বিভোর ছিলেন। গুরুর তত্ত¡বধান ব্যতীত তাঁর ধ্যানানুশীলন চলছিল। তিনি ভয়-ভীতিময় পরিবেশে অহোরাত্রে ধ্যানমগ্ন থাকায় তাঁর প্রতি সকলের অলৌকিক অনুভূতি কাজ করছিল। এই অলৌকিক শক্তি অর্জন, শ্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী মার্গ ফলে পরিপূর্ণ একজন আধ্যাত্মিক সাধকে পরিনত হল। তাঁর এই ধর্মের সুবাতাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ক্্রমশ: বিকশিত করতে লাগল বুদ্ধের ধর্ম প্রচার। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্থবির অভিধায় বরিত হওয়ার বয়োপ্রাপ্ত হলেও অভিষিক্ত হতে পারেন নি। তিনি অহোরাত্র ধ্যান আসনের শ্মশান ভূমিতে পূর্বের মতো সময় না কেটে স্মৃতির সাধনায় নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। ডানহাতের মধ্যমা উপরে রেখে তর্জনী নিচে থেকে ঘর্ষণের প্রক্রিয়ায় যে ‘তুড়ি’ উৎপন্ন হতো, তার সাথে তিনি যোগ করতেন ‘হুম মারে মা পাপ’ এই অমোঘ উচ্চারণ। লোভ, দ্বেষ, মোহ, মান, দৃষ্টি, বিচিকিৎসা. ইত্যাদি ক্লেশ দুঃখ উৎপত্তির কারণ। মানুষ এই ক্লেশকে আপন স্বার্থ উদ্ধারে প্রতিনিয়ত সুখ বলে জানছে। এই সুখ যে, সত্যি দুঃখ, তাই তাঁর স্মৃতি রক্ষায় এ পদ্ধতিতে মানুষকে বিজ্ঞাপিত করতেন। তিনি তাঁর লব্দ অনুভূতির নিরিখে পরের অনুভূতি নিজের মধ্যে স্পষ্ট করতে সমর্থ হতেন। এ ছাড়াও শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা এবং আধ্যাত্মিকতায় একজন পরিপূণ আলোকিত মানুষ হওয়ায় তিনি সকলের কাছে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেন । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমত্যু তিনি রাউজান উপজেলাধীন বিনাজুরীস্থ ইদিলপুরে সর্বানন্দ বড়–য়ার গৃহে অহোরাত্র যাপন করতেন। অনুভুতির গভীরতায় তিনি সমৃদ্ধ ছিলেন। তাই কোন গ্রামে কোন ভক্ত তাঁকে স্মরণ করলে তিনি তা জানতে পারতেন।পরে সেই ভক্তের কাছে ছুটে যেতেন। এভাবে তাঁর আধ্যাত্মিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল। এ যুদ্ধে দুর্ভিক্ষ, দূরাচার, অত্যাচার, সমাজ কাঠামোকে খুবই বিপন্ন করে তুলেছিল। এই গুরু ঠাকুর ছিলেন আত্মজয়ী। তিনি অনাত্মা। তাঁর জ্ঞানে বিধৃত হয়েছিল সংসারের সব সংস্কার ব্যয়ধর্মী অর্থাৎ পরিবর্তনশীল। যিনি নিজে প্রতিনিয়ত নিজের পরিবর্তন লক্ষ্য করেন তিনিই আত্মজয়ী। এই মহাসাধক ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট, শুক্রবার, ১৬ ভাদ্র পারলৌকিক নির্বাণ যাত্রায় চির শায়িত হন। তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে রাউজানের ইদিলপুরে এবং হাটহাজারীর জোবরা গ্রামে ২টি পৃথক স্মৃতি মন্দির গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর তাঁর স্মৃতি মন্দির এলাকাজুড়ে ১৫ জানুয়ারি, ২ মাঘ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় সাধক গুরু গোবিন্দ ঠাকুর ও উপ-সংঘরাজ গুণালংকার স্মরণে নানা ধর্মীয় উৎসব ও মেলা।