আদালতও প্রতারকের খপ্পরে

45

প্রতারণার প্রতিকার পেতে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল বিচারালয় নিজেই এখন একশ্রেণির প্রতারক বা প্রতারক চক্রের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা কিংবা নিজেকে আইনি ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখতে আদালতের সাথে অভিনব প্রতারণার আশ্রয় নিতেও একশ্রেণির অপরাধীর বুক কাঁপছে না। আদালতকে বিভ্রান্ত করতে মামলার বাদীপক্ষ কখনও কখনও প্রকৃত তথ্য গোপন কিংবা মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করছেন। কখনওবা আসামিপক্ষ আইনের শেকলবন্দী না হতে নিজের বদলে অন্যকে দিয়ে আদালতে হাজিরা বা আত্মসমর্পণ করাচ্ছেন। এমনকি, আদালতকে অন্ধকারে রাখায় চেক প্রতারণার ভুয়া মামলার বিচার শেষে রায়ে নির্দোষ ব্যক্তিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়ার ঘটনাও রয়েছে।
অতিসম্প্রতি এক সপ্তাহের ব্যবধানে আদালতে পরপর দুটি চাঞ্চল্যকর প্রতারণার ঘটনা ধরা পড়ার পর গত ৭ মার্চ মূখ্য মহানগর হাকিম মো. ওসমান গণি জামিন শুনানিতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সত্যায়ন করা আসামির জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্টের অনুলিপি জমা দিতে নির্দেশ দিয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করেছেন। এতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি মামলায় আত্মসমর্পণের আসামির জামিন শুনানির ক্ষেত্রে মূল আসামির পরিবর্তে ভিন্ন ব্যক্তিকে উপস্থাপন করার বিষয়টি বিভিন্ন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটগণের নজরে এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে এক আসামির পরিবর্তে অন্য আসামির কারাভোগের ঘটনাও ঘটেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি মামলাও দায়ের হয়েছে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ও বিপজ্জনক প্রবণতা বন্ধে আত্মসমর্পণকৃত সকল আসামির জামিন শুনানির ক্ষেত্রে প্রকৃত আসামি নিশ্চিত করা আবশ্যক। এ কারণে আত্মসমর্পণকৃত আসামির জামিন শুনানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সত্যয়নকৃত আসামির জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা পাসপোর্টের অনুলিপি দরখাস্তের সাথে গ্রহণ করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটগণকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। আগামী ১৮ মার্চ থেকে জামিন শুনানির আগে আবেদন দাখিলের সময় এ ধরনের পরিচয়পত্র নথির সাথে সংযুক্ত করতে হবে বিচারপ্রার্থীদের। এতে করে, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কিংবা আদালতকে বিভ্রান্ত করে নিজের পক্ষে আদেশ আদায়ের অপচেষ্টা অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আদালত সূত্র জানায়, পাওনা টাকা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে আনোয়ারার বাসিন্দা মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত ধারায় আদালতে মামলা করেন রাউজানের জনৈক মো. রফিক। এই মামলায় পরোয়ানা জারির পর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান আসামি মোজাম্মেল। পরে জামিনে এসে তিনি পলাতক হয়ে যান। এই মামলার রায়ে ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর আদালত মোজাম্মেলকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেন। চলতি বছরের গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সাজাপ্রাপ্ত আসামি মোজাম্মেল নিজে আত্মসমর্পণ না করে মহানগর হাকিম আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে নিকটাত্মীয় দিদারুল আলমকে হাজির করান। দিদারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল এই কাজের জন্য তাকে দশ হাজার টাকা দেবেন মোজ্জাম্মেল। কিন্তু শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে মোজাম্মেল সেজে আসা দিদারকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আর তাতেই কাঠগড়ায় থাকা দিদার কান্না করতে থাকেন। তিনি আদালতকে বলতে থাকেন, ‘স্যার আমি দিদার, মোজাম্মেল নই। তিনি বারান্দায় আছেন। আমি আসামি না।’এই ঘটনায় আদালতের বেঞ্চ সহকারী বখতিয়ার উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। পরে দুজনকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই ঘটনার রেশ না কাটতেই গত ৬ মার্চ একই আদালতে একটি চেক প্রত্যাখ্যানের মামলার আসামি ওয়াহিদুল হক নিজে আত্মসমর্পণ না করে সৈয়দ করিম নামের এক ব্যক্তিকে হাজির করে আত্মসমর্পণ করান। আইনজীবী ফারহান এমরান আসামির আত্মসমর্পণের দরখাস্ত দাখিল করে জামিন চাইলে হাজির করা আসামিকে দেখে বিচারকের সন্দেহ হয়। আসামির নাম, পিতার নাম, মায়ের নাম অনবরত জানতে চাইলে আসামি ঘাবড়ে যান। আসামিকে তার নাম স্বাক্ষর করতে বললে নথিতে থাকা চেকের স্বাক্ষরের সঙ্গে মিল না পাওয়ায় বিচারক আসামিকে সত্য স্বীকার করার নির্দেশ দেন। পরে স্বীকার করেন, মূল আসামি ওয়াহিদুল হকের পরিবর্তে নিজে হাজির হয়েছেন। এই ঘটনায় থানায় মামলা করা হয় আদালতের পক্ষ থেকে।
ভুয়া প্রতারণার আট মামলায় একই পরিবারের চারজনের দন্ড ঃ আদালত সূত্র জানায়, এর আগে জনৈক মো. মোরশেদ ২০১৫ সালের ১৫, ১৭ ও ২৩ সেপ্টেম্বর দশটি চেক প্রত্যাখ্যাত (ডিজঅনার) হওয়ার মামলা করেন। এর মধ্যে নয়টি চেকে ৩০ লাখ টাকা করে মোট দুই কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং অন্যটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যমানের চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার মামলা। ওই মামলাগুলোর কথিত আসামিরা হলেন- ইপিজেড থানাধীন নিউমুরিং এলাকার জনৈক রেজিয়া বেগম এবং তার তিন সন্তান ফারহানা সুলতানা, সাবরিনা সুলতানা ও সৈয়দ আবদুল দায়ান। মামলার আর্জিতে বাদী মোরশেদ এই চারজনকে সানরাইজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড নামে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক উল্লেখ করেন। অথচ আসামিরা একটি শ্রমিক পরিবারের সদস্য। ওই শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের কোনওরকমের সংশ্লিষ্টতা নেই। রেজিয়া বেগমের স্বামী আবদুল হাই বন্দরের মজুরিভিত্তিক শ্রমিক। এক মেয়ে স্নাতক পাস করেছেন। আরেক মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন। একমাত্র ছেলেটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি। আপাদমস্তক একটি শ্রমজীবী পরিবারকে শিল্পকারখানার মালিক সাজিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করে এসব মামলা করা হয়। এর মধ্যে আটটি মামলায় ওই চারজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়। আদালতের রায় ঘোষণার পর ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে আসামির বাড়িতে গেলে তারা আত্মগোপন করেন।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব খান বলেন, ‘কোনও কোনও সময় আসামি নিজের বদলে অন্যকে দিয়ে আত্মসমর্পণ করান। তবে, আইনজীবীরা এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন না। মক্কেল পরিচয় গোপন করে থাকেন। এখন থেকে এটি করতে পারবেন না। সবার এটি মেনে চলা উচিত।’
প্রতারণার ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্টের পদক্ষেপ ঃ গত বছরের অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি শুভ্রা ঘোষের দ্বৈত বেঞ্চে একই ধরণের ধোঁকা দেয়ার অপচেষ্টা চালায় গৃহবধূ হত্যা মামলার অভিযুক্ত পক্ষ। হাজতবাস এড়াতে কারসাজির মাধ্যমে আদালতকে বিভ্রান্ত করতে তথ্য গোপন করে পেশ করা হয়েছিল আগাম জামিনের আবেদন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আদালতকে ধোঁকা দেয়ার অপচেষ্টা ধরা পড়ে যাওয়ায় অভিযুক্ত স্থানীয় রঘু শেখের গোটা পরিবারকেই গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ বিচারপতিদের নির্দেশ, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কারাগারই হবে তাদের ঠিকানা। আদেশে দুই বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘আদালতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা একটি বিপজ্জনক ঝোঁক। ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটা করার জন্য তাদের অবশ্যই বড় মূল্য দিতে হবে’। এটাও জানিয়ে দেয়া হয় যে, যতদিন না পর্যন্ত মূল মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে ততদিন ওই চার অভিযুক্তকে কারাগারে থাকতে হবে। কোনও জামিন মিলবে না। রঘু শেখের আইনজীবীকেও তুলোধুনো করেন আদালত।