আত্মসমর্পণের পর কী হবে তাদের

60

ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে দেশজুড়ে। আজ শনিবার টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে ইয়াবা কারবারীরা। অন্তত ১০৮ জন ইয়াবা কারবারী আত্মসমর্পণ করার কথা থাকলেও মূল গডফাদাররা সে তালিকায় নেই। আত্মসমর্পণের পর তাদের কি গতি হবে-তা কেউ বলতে পারছেন না। মামলা বা তাদের অবৈধ সম্পদের কি হবে সে উত্তরও কারো কাছে নেই।
জানা যায়, কয়েক মাস ধরে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া চলে আসছে। এরই মধ্যে ১০৮ জনের মতো ইয়াবা কারবারি জেলা পুলিশের সেফহোমে উপস্থিত হয়েছে। এদের মধ্যে সাবেক এমপি বদির তিন ভাই, উপজেলা চেয়ারম্যানপুত্র, পৌর কাউন্সিলর, অর্ধডজন ইউপি সদস্যসহ ২৫ গডফাদার রয়েছে। বাকিরা শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী। গত কয়েক দিন ধরে বিশেষ গোপনীয়তায় তাদের পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়।
অনেকের মতে, এটা ইয়াবার বড় কারবারিদের জীবন রক্ষার কৌশল মাত্র। তারা বন্দুকযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচার মতলবে নিজেরাই একটা পথ তৈরি করেছে। আর যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে ইতোমধ্যে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে তাদের পরিবার এই ‘ধরা দেওয়ার’ ঘোর বিরোধী। অবশ্য পুলিশ বলছে, যারা আত্মসমর্পণ করবে তারা ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা আদালতে মোকাবিলা করার সুযোগ পাবে। তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে কোনো মামলাও হবে না। আর যারা আত্মসমর্পণ করবে না তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।
জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সর্বশেষ তালিকায় কক্সবাজারে ইয়াবার গডফাদার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় ৭৩ জন। এদের মধ্যে মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে ১০ জন। পুলিশ হেফাজতে রয়েছে ২৫ জন। এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে ৩৮ জন গডফাদার। বিশেষ করে কক্সবাজার শহর, চকরিয়া, মহেশখালী ও রামুর ইয়াবা গডফাদার এবং শীর্ষ ব্যবসায়ীরা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের সেফহোমে যেসব ইয়াবা গডফাদার রয়েছে তারা হল-উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির তিন ভাই যথাক্রমে শফিকুল ইসলাম প্রকাশ শফিক, আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান, বদির ভাগিনা সাহেদ রহমান নিপু ও সাহেদ কামাল।
এ ছাড়া রয়েছে টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে দিদার মিয়া ও পৌর কাউন্সিলর নুরুল বশর ওরফে নুরশাদ, বিভিন্ন ইউনিয়নের অর্ধডজন ইউপি সদস্য। তারা হলেন-পশ্চিম লেদার নুরুল হুদা মেম্বার, নাজিরপাড়ার এনামুল হক মেম্বার, সাবরাংয়ের মোয়াজ্জেম হোসেন প্রকাশ ধানু মেম্বার, আলী খালির জামাল মেম্বার ও শাহপরীর দ্বীপের রেজাউল করিম মেম্বার।
এ ছাড়াও রয়েছে-আলী আহমদ চেয়ারম্যানের দুই ছেলে আবদুর রহমান ও জিয়াউর রহমান, হ্নীলার পশ্চিম সিকদার পাড়ার ছৈয়দ আহমদ, নাজিরপাড়ার আবদুর রহমান, পুরাতন পল্লান পাড়ার শাহ আলম, জাহাজপুরার নুরুল আলম, হ্নীলা পশ্চিম সিকদার পাড়ার রশিদ আহমদ, ওয়ালিয়াবাদের মারুফ বিন খলিল বাবু, মৌলভীপাড়ার একরাম হোসেন, মধ্যম ডেইল পাড়ার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, চৌধুরী পাড়ার মং সং থেইন প্রকাশ মমচি ও দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার জুবাইর হোসেন।
অন্যরা হলো-হ্নীলা পূর্ব পানখালীর নজরুল ইসলাম, পশ্চিম লেদার নুরুল কবীর, নাজিরপাড়ার সৈয়দ হোছন, নাইটং পাড়ার মো. ইউনুচ, সাবরাং আলীর ডেইলের জাফর আহমদ, হ্নীলা ফুলের ডেইলের রুস্তম আলী, শামলাপুর জুমপাড়ার শফিউল্লাহ, একই এলাকার ছৈয়দ আলম, উত্তরলম্বরীর আবদুল করিম প্রকাশ করিম মাঝি, রাজারছড়ার আবদুল কুদ্দুছ, জাহেলিয়া পাড়ার মো. সিরাজ, সাবরাংয়ের আবদুল হামিদ, নাজিরপাড়ার মো. রফিক, নতুন পল্লান পাড়ার মো. সেলিম, নাইট্যংপাড়ার মো. রহিম উল্লাহ, নাজির পাড়ার মো. হেলাল, চৌধুরী পাড়ার মোহাম্মদ আলম, তুলাতলীর নুরুল বশর, হাতিয়াঘোনার দিল মোহাম্মদ, একই এলাকার মোহাম্মদ হাছন, দক্ষিণ নয়াপাড়ার নুর মোহাম্মদ, সদর কচুবনিয়ার বদিউর রহমান, পূর্ব লেদার জাহাঙ্গীর আলম, মধ্যম জালিয়া পাড়ার মোজাম্মেল হক, ডেইল পাড়ার আবদুল আমিন, উত্তর আলী খালীর শাহ আজম, দক্ষিণ নয়াপাড়ার আলমগীর ফয়সাল, সাবরাং ডেইল পাড়ার মো. সাকের মিয়া, সাবরাংয়ের আলী আহমদ, উত্তর শীলখালীর মো. আবু ছৈয়দ, জাদিমুরার মোহাম্মদ হাসান আবদুল্লাহ, রাজার ছড়ার হোসেন আলী, সাবরাং নয়াপাড়ার মো. তৈয়ব, উত্তর জালিয়া পাড়ার নুরুল বশর মিজি, নাজির পাড়ার জামাল হোসেন, মৌলভী পাড়ার মো. আলী ও এই এলাকার আবদুল গনি।
জানা যায়, স¤প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে ৫১ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী মারা গেছে। এদের মধ্যে ১০ জন ইয়াবার গডফাদার। তারা হলো-আকতার কামাল, একরামুল হক, শামশুল হুদা, ইমরান প্রকাশ পুতিয়া মেস্ত্রী, মো. কামাল, জিয়াউর রহমান, হাবিব উল্লাহ, মো. ইউচুফ জালাল বাহাদুর, মোস্তাক আহমদ মুছু ও বার্মাইয়া শামশু।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসাইন বলেন, ইয়াবা নির্মূলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। যারা এর আগে পুলিশ হেফাজতে এসেছে তারা নিজের অপরাধ বুঝেই এসেছে। সুতরাং তাদের যেভাবে দেখা হচ্ছে পলাতকদের ওভাবে দেখার সুযোগ নেই।
পুলিশ সুপার বলেন, ইয়াবা গডফাদার কিংবা শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর কেউই আইনের আওতার বাইরে থাকতে পারবে না। যেভাবেই হোক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এখন অপরাধীরা যে সুযোগ পাচ্ছে, হয়তো সামনে তা নাও পেতে পারে। সুতরাং সময় থাকতে সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি। তিনি বলেন, সব কিছু বিধি মেনেই হবে। আইনের বাইরে কিছুই হবে না।
তবে শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে আত্মসমর্পণের তালিকায় না থাকা সাবেক এমপি বদি, মূল হোতা সাইফুল করিম, ইউসুফ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, তালিকায় থাকা ইয়াবা কারবারিদের বলা হয়েছে-আত্মসমর্পণ করার পর ছয় মাস জেল খাটলে বের হয়ে যেতে পারবে। তখন আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের খুঁজবে না। নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। এছাড়া উচ্ছেদ শুরু হওয়া তাদের সুরম্য অট্টালিকাও রক্ষা পাবে। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় জড়িত মহলটিই তাদের এ ধারণা দেয়।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এক. আত্মসমর্পণের সময় তারা যদি ইয়াবা বড়িসহ আত্মসমর্পণ করে, তাহলে কি হবে। দুই. তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা ও সম্পদের বিষয়টির ফয়সালা হবে কিভাবে। দ্বিতীয় কারণটি নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা একমত হয়েছেন। তারা বলছেন, ইয়াবা কারবারিদের তালিকা তৈরির পর তা সিআইডি ও দুদকের হাতে দেওয়া হবে। মামলা ও সম্পদের বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখবেন। আত্মসমর্পণ করলেই কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
ইয়াবাসহ আত্মসমর্পণ করলে কী হবে, তা নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি পুলিশ প্রশাসন। প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট পরিমাণ ইয়াবাসহ আটক ব্যক্তির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড।