আজ বিশ্ব নদী দিবস : নদী বাঁচাও দেশ বাঁচাও

36

রেজা মুজাম্মেল

নদী- শব্দটাই যেন মায়াময়। মায়ায় ঘেরা। নদীতেই আছে অপার প্রাকৃতিক সম্পদ। নদী তার সম্পদ- মৎস্য ও পানি অকাতরে দান করছে মানুষকে। সৃষ্টিজগত কেবলই নদী থেকে সুফল ভোগ করেই চলেছে। কালনিরবধি নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, নৌ পরিবহন ব্যবস্থা অব্যাহত আছে। প্রশ্ন জাগতে পারে- সুফলভোগকারী মানুষ হিসাবে প্রাকৃতিক সম্পদ নদীকে আমরা কি দিয়ে থাকি। কিংবা নদী আমাদের কাছে কি চাই। সজজেই বলা যায়, নদীকে আমরা কিছু দিই না। বরং প্রতিনিয়ত নদী থেকে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বিরক্ত করা হয় নদীকে। বিপর্যস্ত করে তোলা হয় দূষণ-দখল ও ভরাট করে। নদীকে নদীর চরিত্রে থাকতে দেয়া হয় না। অত্যাচার-নির্যাতনে বদলে দেওয়া হয় নদীর আপন রূপ, বৈশিষ্ট্য, স্বকীয়তা। প্রকৃতিও অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিশোধ নিয়ে থাকে সময়, অবস্থা ও পরিবেশ বুঝে।
দুই. আজ বিশ্ব নদী দিবস। নদী রক্ষায় সচেতনতা ও তৎপরতা বাড়াতে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার গোটা পৃথিবীজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব নদী দিবস। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৮০ সালে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া (বিসি) ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি দিবসটি পালন শুরু করে। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘বিসি রিভারস ডে’ পালনের মধ্য দিয়ে। ১৯৮০ সালে কানাডার খ্যাতনামা নদীবিষয়ক আইনজীবী মার্ক অ্যাঞ্জেলো দিনটি ‘নদী দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিসি রিভারস ডে পালনের সাফল্যের হাত ধরেই তা আন্তর্জাতিক রূপ পায়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ নদী রক্ষায় জনসচেতনতা তৈরি করতে ‘জীবনের জন্য জল দশক’ ঘোষণা করে। সে সময়ই জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে। এরপর থেকেই জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। যা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে বিশ্ব নদী দিবস পালন শুরু হয়। প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ৬৫টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। তবে বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য দেশ অনুযায়ী ঠিক করা হয়।
তিন. দেশে বর্তমানে প্রবহমান নদীর সংখ্যা ৪০৩টি। কিন্তু এর মধ্যে অধিকাংশ নদীর পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। তবে দেশের বিপর্যস্ত নদীগুলোকে রক্ষায় উচ্চ আদালত একটি যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেছেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উচ্চ আদালতের এক রায়ে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রায়ে সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা এবং নদ-নদী সুরক্ষায় নদী রক্ষা কমিশনকে এর আইনগত অভিভাবক ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে নদী দখলকারীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা এবং ব্যাংক ঋণ না দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলা হয়। তাছাড়া জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রথমবারের মতো নদী-খাল-বিল দখলদারদের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সচেতন মহল মনে করছে, আদালতের নির্দেশনা এবং পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত সময়োপযোগী। সরকারের উচিত আদালতের নির্দেশনা মতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। নদী বাঁচাতে এগিয়ে আসা। আদালতের নির্দেশনা কার্যকর করে দেশের নদ-নদীগুলো বাঁচানো। কারণ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব এবং দখল-দূষণের কারণে দেশের নদ-নদীর সংখ্যা ও আয়তন দুটোই কমছে। নদীর আয়তন কমা এবং দখল-দূষণ পরিবেশ ও মানুষের জীবন-জীবিকাকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
চার. দেশের নদ-নদী উদ্ধারে সরকার ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর সারা দেশের নদ-নদী অবৈধ দখলমুক্ত করতে সরকার উচ্ছেদ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে সরকারের ১০০ বছর মেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান অনুসারে সারাদেশের নদ-নদী, খাল ও জলাশয় দখল ও দূষণমুক্তকরণ, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে। এ জন্য আটটি বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এরই মধ্যে সারা দেশের জেলাভিত্তিক নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছে। তাছাড়া, নদী খনন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীপথ সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি পুনরদ্ধার ও ৩৫০ কিলোমিটার নৌপথ সংরক্ষণ করা হবে। তদুপরি, নদীকে স্বরূপে ফেরাতে নেয়া হয়েছে কর্মপরিকল্পনা। এর মধ্যে আছে সারাদেশের পানিসম্পদের সদ্ব্যবহার, নদ-নদী দূষণরোধ ও রক্ষায় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা, পাঠ্যপুস্তকে নির্দিষ্ট কারিকুলাম সংযোজন করা, ভবিষ্যতে নদীর জায়গা বেদখল হওয়া বন্ধে জনগণকে সম্পৃক্ত করা, জমি ক্রয়ের আগে কোনো নদীর অংশ কিনা তা উল্লেখ করতে আইনের ধারা সংযুক্ত করা, আবর্জনা যথাস্থানে ফেলতে বাক্স বা ঝুড়ি সংরক্ষণ করা, নদীতে বিষাক্ত বর্জ্য, নির্গত আবর্জনা ও ময়লা ফেলা বন্ধে প্রচারপত্র বিলি, নদীর বর্জ্য উত্তোলনের জন্য বর্জ্য উত্তোলন উপযোগী জাহাজ কেনার পরিকল্পনা।
অন্যদিকে, ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে দেশের জেলা প্রশাসকদের কাছে ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনার নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনায় নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ, তালিকা অনুসারে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা, নদীর সীমানা চিহ্নিত করা, উদ্ধার করা নদ-নদী ও তীরভূমি যাতে পুনঃ দখল না হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন/উপজেলা ভূমি অফিসের নিয়মিত পরিদর্শন ও নজরদারির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগগুলো যুগোপযোগী। এখন দরকার নদী রক্ষায় সরকারের নির্দেশনা জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা। বেদখল হয়ে যাওয়া নদী উদ্ধারে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্যথায় কালের গহবরে নদীগুলো হারিয়ে যাবে।
পাঁচ. প্রতিযোগিতা হারে দখল ও ভরাট হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। একটি জরিপ প্রতিবেদন মতে, কর্ণফুলী ব্রিজ নির্মাণের সময় এডিবি মাস্টারপ্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী কর্ণফুলীনদীর দৈর্ঘ্য ছিল ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। বর্তমানে কর্ণফুলী নদী ভাটার সময় প্রস্থ মাত্র ৪১০ মিটার এবং জোয়ারের সময় চর অতিক্রম করে ৫১০ মিটার পর্যন্ত জোয়ারের পানি আসে। ভরাট হয়ে যাওয়ায় অংশে কোনো নৌযান চলাচল করে না। নদী ভরাট হওয়ায় শাহ্ আমানত সেতুর মাঝ পিলারের পাশে অঘোষিত একটি যাত্রী পারাপার ঘাট তৈরি করেছেন স্থানীয়রা। জোয়ার ভাটার সময় লিংক রোড থেকে অর্ধ কিলোমিটার নদীর অংশ পায়ে হেঁটে যাত্রীরা ব্রিজের নিচে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে এসে সাম্পানে ওঠে। চাক্তাই খালের মুখে এসে বিএস সিট ও এডিপি মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নদীর প্রস্থ ৯৮২ মিটার। বাস্তবে নদী ৫১০ মিটার। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্মিত মেরিনার্স সড়ক এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ৯৮১ মিটার। বন্দর কর্তৃপক্ষ বর্তমানে সেই অংশে খনন করেছে। খননের পর নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮৫০ মিটার। এরপর ফিরিঙ্গি বাজার মোড়ে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ৯০৪ মিটার। বর্তমানে বন্দর খনন করার পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার। বাকি অংশ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মাণ করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। শাহ আমানত ব্রিজ এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ৪১০ মিটার হওয়ায় ধসে পড়তে পারে সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত। (সুত্র : চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন)। অভিন্ন চিত্র হালদা নদীরও। তবে এ নদী দখলের চেয়ে দূষণের মাত্রা বেশি। বলা যায়, দূষণের কবলে পড়ে নদীটি আগামীতে তার স্বকীয়তা হারাবে।
সাত. দেশের নদ-নদী আদালতের নির্দেশনা এবং সরকারের ক্র্যাশ প্রোগ্রামসহ নানা উদ্যোগ চলমান। আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, এসব মন্ত্রণালয় ও দপ্তর কি সত্যিকার অর্থে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে? নদী রক্ষায় কি আন্তরিকভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করছে? দখল-দূষণ ঠেকাতে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে? নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোরতা প্রদর্শন করেছে। নতুন করে দখল ঠেকাতে ভূমিকা রাখছে? শিল্প-বাণিজ্য-আবাসিক বর্জ্য থেকে বাঁচাতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নদীর নাব্যতা রক্ষায় কি নিয়মিত ড্রেজিং করা হচ্ছে? নদ-নদী রক্ষায় অভিযান পরিচালিত হয়, তা কি যথেষ্ট? অভিযানের কি আশানুরূপ সুফল পাওয়া যায়। উচ্ছেদকৃত স্থান কি পরবর্তীতে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সংস্থা-দপ্তরগুলোর মধ্যে কি সমন্বয় আছে। সমন্বয়ের অভাবে নদীর পরিবেশ-অবস্থা-বৈশিষ্ট্য নষ্ট হচ্ছে না তো? অতএব, আর নয় দখল-দূষণ। এবার নদী বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। প্রকৃতিকে বাঁচান। নদী-প্রকৃতি বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। দেশ বাঁচলেই মানুষের অস্তিত্ব।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী