আজ উপকূলে আছড়ে পড়বে ‘আম্ফান’

71

সাগরবক্ষে কখনও শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধি আর কখনওবা অভিমুখ বা বাঁক বদলে উপকূলের আরও কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট শতাব্দীর প্রথম সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’। খানিক পরপর বাঁক বদলের কারণে ঠিক কোন উপকূল দিয়ে এটি সাগরবক্ষ থেকে স্থলভাগে প্রবেশ করবে সে সম্পর্কে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আবহাওয়াবিদরা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারলেও আজ বুধবার সন্ধ্যার মধ্যেই ঘূর্ণিঝড়টি দেশের উপকূল অতিক্রম করবে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। তার জেরে সতর্ক ও বিপদ সংকেত নামিয়ে আজ সকালেই মহাবিপদ সংকেত জারি করতে পারে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়ার গতিপথ পর্যবেক্ষণকারী প্রতিবেশি ভারত ও দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা সর্বশেষ তাদের ধারণা প্রকাশ করে বলেছেন, ভারতের উড়িষ্যা থেকে পশ্চিমবঙ্গের দিঘা হয়ে বাংলাদেশের খুলনা থেকে হাতিয়া পর্যন্ত- এই অঞ্চলের যে কোনও উপকূল দিয়েই ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগে প্রবেশ করতে পারে। গতকাল মঙ্গলবার দিনের প্রথমভাগে সেটি প্রথম দফায় বাঁক নিয়ে
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সুন্দরবনকে অভিমুখ করে এগোতে থাকে। কিন্তু সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দফায় বাঁক বদল করে উড়িষ্যা উপকূলমুখী হয়। আজ বুধবার সকালের মধ্যে উপকূলে একেবারে কাছে পৌঁছানোর পরই সেটি স্থলভাগে প্রবেশ করবে। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টির আরও বাঁক বদলের সুযোগ রয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ উপকূলের দিকে ধেয়ে আসায় বুধবার সকাল ছয়টায় মহাবিপদ সংকেত জারি করা হবে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভাশেষে প্রতিমন্ত্রী এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৫১ লাখ ৯০ হাজার লোক থাকার ব্যবস্থা থাকলেও আমরা ২০ থেকে ২২ লাখ লোককে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেভাবেই জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে নয়টায় দেশের সরকারি আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ একেএম রুহুল কুদ্দুছ স্বাক্ষরিত সর্বশেষ (ক্রমিক নম্বর ২৮) বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় আম্ফান উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছে। এটি মঙ্গলবার দিবাগত রাত নয়টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সাতশ’ ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার উপকূল থেকে ছয়শ’ ৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ছয়শ’ ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ছয়শ’ ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর ও উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে আজ বুধবার বিকাল বা সন্ধ্যার মধ্যে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় দুইশ’ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে দুইশ’ ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা,পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহসাত নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। এছাড়া, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজার উপকূলকে ছয় নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ছয় নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। ঘূর্ণিঝড় এবং অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে দশ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ¡াসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রমকালে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলাসমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘন্টায় একশ’ ৪০ থেকে একশ’ ৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতিসত্ত¡র নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত সোমবার সন্ধ্যায় আম্ফান ‘সুপার সাইক্লোন’ এ পরিণত হয়। বিগত ২০০৪ সালে থাইল্যান্ড এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়েছিল। আম্ফানের বাংলা অর্থ হল ‘আকাশ’। ১৯৯৯ সালের উড়িষ্যা ঘূর্ণিঝড়ের পরে এটিই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া প্রথম ‘সুপার সাইক্লোন’। পৃথিবীর ইতিহাসে পঞ্চম প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে স্বীকৃত ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ও সুপার সাইক্লোন আম্ফানের মত একই গতিপথ অনুসরণ করেছিল। ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা অনুসারে আম্ফানের পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নাম হবে ‘নিসর্গ’। এই নাম বাংলাদেশের দেয়া। সারাবিশ্বে ১১টি সংস্থা ঘূর্ণিঘড়ের নিজ নিজ অঞ্চলের সাগরবক্ষে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে থাকে।
প্রতিবেশি দেশ ভারতের বেসরকারি আবহাওয়া পূর্বাভাস সংস্থা স্কাইমেট জানিয়েছে, উপকূলের কাছাকাছি এলে এই অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বা সুপার সাইক্লোনের শক্তির তীব্রতা সামান্য কমে। তবে তারপরেও এর বিধ্বংসী ক্ষমতাকে খাটো করে দেখার কোনও সুযোগ নেই। সাধারণত স্থলভূমি থেকে শুষ্ক বাতাস এসে ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ ও ক্ষমতাকে কিছুটা দুর্বল করে দেয়। সুপার সাইক্লোন আম্ফানের ক্ষেত্রেও একই ধরণের প্রভাব পড়বে। তবুও এটি যেহেতু একটি সুপার সাইক্লোন, সেহেতু ঘূর্ণিঝড়টির তান্ডবলীলা চালানো বা ক্ষয়ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা মারাত্মক।
উল্লেখ্য, দেশে এর আগে ১৯৭০ সালে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। এরপর ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন’ চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। প্রায় একই ধরণের আরেকটি ঘূর্ণিঝড় ছিল ২০০৭ সালের সিডর। যদিও তাতে মানুষের মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম ছিল। সিডরে প্রাণ হারায় তিন হাজার চারশ’ ছয় জন। এর দু’বছরের মাথায় ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র আঘাতে মারা যায় একশ’ ৯০জন। আর ২০১৩ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’-এ মারা যায় ১৮ জন। এভাবে ২০১৫ সালে ঘুর্ণিঝড় ‘কোমেন’, ২০১৬ সালে ‘রোয়ানু’, ২০১৭ সালে ‘মোরা’ দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ভয়ঙ্কর তান্ডবলীলা চালায়। ততে প্রাণহানি না হলেও ঘরবাড়ি ও গাছপালাসহ সম্পদহানি ঘটেছিল। সর্বশেষ ২০১৯ সালে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ ও ‘বুলবুল’। যদিও এ দুটি ঘূর্ণিঝড় প্রতিবেশি দেশ ভারতের উপকূলীয় কয়েকটি রাজ্যের স্থলভাগে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অনেকটা শক্তি হারিয়ে দেশের উপকূল অতিক্রম করে। ফলে দেশের উপকূলীয় এলাকায় বড় ধরণের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারেনি।