আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন, শুরু হলো বর্ষা

154

গ্রীষ্মের বিদায়ক্ষণে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু টেকনাফ উপকূল থেকে চট্টগ্রাম, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগ অতিক্রম করে এরইমধ্যে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। তাতে কাগজে-কলমে বর্ষা মৌসুম শুরু হলেও পঞ্জিকার হিসেবে আজ বর্ষা ঋতুর প্রথমদিন পয়লা আষাঢ়। গতকাল জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে চট্টগ্রামের ফেনী ও সিলেটের শ্রীমঙ্গলে যথাক্রমে একশ’ ২২ ও একশ’ ১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে।
জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই মৌসুমী বারি ধারায় সিক্ত হয়েছে মানুষের মন। আজ পয়লা আষাঢ়েও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার আভাসও দিয়েছে আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তারা। বদলে যাওয়া প্রকৃতির প্রভাবেই মন আকুল করা বাঙালির ঋতুভিত্তিক আবেগ আজ তাই কড়া নাড়বে পথচলা পথিকের হৃদয়ের গহীনে। বঙ্গাব্দের হিসেবে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি মেনে এ সময় ধরা দেয় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু। যার প্রভাবে বৃষ্টি হয় প্রচুর। এ কারণেই বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টির রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। আর নিয়মিত বর্ষণে চারপাশের পরিবেশ হয়ে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর। জলের ধারায় সহজাতভাবেই স্নানটা সেরে নেয় প্রকৃতি। বেড়ে যায় গাছের পাতা থেকে শুরু করে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠভরা ঘাসের সজীবতা। বর্ষার জলের ধারায় যেন আরও বেশি তীব্রতা ছড়ায় নিসর্গের সবুজ রংটি। এমন রঙের উৎসবের পাশাপাশি বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার মন মাতানো সুবাসে প্লাবিত হয় চারপাশ। সে সঙ্গে আছে কবির ভাষায় বর্ষার প্রতীক হয়ে ওঠা ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল’। শহর থেকে গ্রাম সবখানেই সবুজ-হলুদ ও সাদা-এ তিনস্তরে বিন্যস্ত দৃষ্টিনন্দন ফুলটির দেখা মিলে বর্ষাকালে। আবার কোনও এক বৃষ্টিভেজা দিনে অপরূপ সুন্দর পেখম মেলে বর্ষার জয়ধ্বনিতে মুখর হবে ময়ূর। রিমঝিম বর্ষার প্রাণচাঞ্চল্যে তাই তো সুযোগ পেলে পথচলতি কিশোর-কিশোরী বা যুবা জলের ধারায় দাঁড়িয়ে ভিজিয়ে নিতে চাইবে নিজেকে। আর শহুরে জীবনে তুমুল বৃষ্টিতে আশপাশে খোলা জায়গা খুঁজে না পেলে বাসাবাড়ির ছাদে উঠেই ঘটবে বর্ষা আলিঙ্গন। এমনই রূপময়তায় ধরা দুই মাসব্যাপী বর্ষাঋতু। আর কৃষিজীবী জীবনে বাদল দিনের তাৎপর্য উঠে আসে ভূপেন হাজারিকার গানের সুরে- ‘আষাঢ়-শ্রাবণ চাষের কাজে ব্যস্ত আমি রই…।’ তার মানে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বর্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ওস্তাদ মোমতাজ আলী খানের সুরে উচ্চারিত হয়- ‘আইলো আষাঢ় লইয়া আশা/ চাষীর মনে বান্ধে বাসা…।’
নানামুখী সৌন্দর্য ও তাৎপর্যের পাশাপাশি বর্ষায় কিছুটা বিপদের ঝুঁকিও রয়েছে। ভারি বর্ষণ বা পাহাড়ি ঢলে ভেসে যেতে পারে গ্রামের পর গ্রাম। সে কারণে বন্যাপ্রবণ সমতল এলাকার মানুষ আতঙ্কে পার করে বর্ষাকাল। শুধু তাই নয়, অথৈ জলের তোড়ে তলিয়ে যেতে পারে কৃষকের আবাদি ফসলের জমিটি। আবার অতিবৃষ্টির কারণে শহুরে নাগরিকের রয়েছে জলাবদ্ধতার শিকার হওয়ার ঝামেলা। তবে, কিছু বিপদের কথা বাদ দিলে সব মিলিয়েই ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা স্বস্তিময় শান্তি অনুভূতিই নিয়ে আসে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্য প্রকাশিত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরপূর্ববঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারী ধরণের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসাথে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারী ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। গতকাল শুক্রবার জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে ঢাকার নিক্লিতে ৪৩, ময়মনসিংহে ৪১, নেত্রকোণায় ৫৮, চট্টগ্রাম সদরে ৯, স›দ্বীপে ৬৯, রাঙামাটিতে ২০, কুমিল্লায় ১৮, হাতিয়য়ি ৫০, কক্সবাজারে ৪৮, সিলেটে ৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এর আগে গত মে মাসের শেষদিকে প্রতিবেশি ভারতের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ওয়েদার অব ওয়েস্টবেঙ্গল এবারের বর্ষার নির্ঘন্ট ও অর্ধশত বছরের বর্ষার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস দিয়েছিল। তাতে বলা হয়, ইন্ডিয়ান ওসিয়ানিক ডাইপোল পজিটিভ হওয়া এবং এল নিনো তীব্রতা কমে যাওয়ায় উত্তর পূর্ব ভারতের অধিকাংশ রাজ্যগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশেও এবারের বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেক্ষেত্রে এ বছর বর্ষায় ভারতের আসাম, মেঘালয়, মণিপুর ও ত্রিপুরার মত বাংলাদেশের চট্টগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে স্বাভাবিকের থেকে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যাবে। ওয়েদার অব ওয়েষ্টবেঙ্গলের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ বছর বর্ষায় যথেষ্ট বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে এবং কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হবে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলিতে। এর ফলে চট্টগ্রামসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো অতি ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর অর্থাৎ ১৪২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখেই ‘শ্রাবণের উপস্থিতি’ আগাম বর্ষার একধরণের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেই বছর মধ্য বৈশাখ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা গত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে, এবার কালবৈশাখী মৌসুমের দৈর্ঘ্য বাড়লেও বিদায় নিতে যাওয়া গ্রীষ্মকালজুড়ে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপদাহ বয়ে গেছে। সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণাসহ কিছু কিছু অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে কালবৈশাখীর দাপট পরিলক্ষিত হলেও সামগ্রিকভাবে তাপদাহেই পুড়তে হয়েছে বেশিরভাগ এলাকার মানুষকে। একটানা কয়েকবছর দেশে বর্ষাঋতুর দৈর্ঘ্য অনেকটা কমে এসেছিল। আগাম বন্যা ঠাঁই নিতে শুরু করেছিল ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু, ২০১৭ সালে বাঁক বদল ঘটিয়ে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয় বর্ষাকাল। ওইবছর দেশে বন্যায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় অর্ধ কোটিরও বেশি বন্যাদুর্গত মানুষকে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানিতে ফসল তলিয়ে যায়। এছাড়া, বন্যাকবলিত অন্তত ৩২টি জেলার বাড়িঘর ও ফসলাদি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। দেশের নদ-নদীর পানির ৯৩ শতাংশই আসে উজানের দেশগুলো অর্থাৎ নেপাল, ভারত এবং কিছুটা ভুটান থেকে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ওপরই বাংলাদেশে বন্যা হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে। উজানের পাশাপাশি দেশে অতিবৃষ্টি হলে জুনের শেষ দিক থেকে ক্রমাগতভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। আর নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে দেশের তিনটি নদী অববাহিকার তিনশ’ ৪৩ টি পানি সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান নদ-নদীর ৯০টি পয়েন্ট থেকে ৫৪টি পয়েন্টে পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দেয়া হয়।