আজও চোখের জলে ভাসেন স্বজনরা

58

ট্র্যাজেডি শব্দটি শুনলে আঁতকে উঠেন মিরসরাই জনপদের মানুষ। এ জনপদের বিষাদময় একটি অধ্যায়ের নাম ‘মিরসরাই ট্র্যাজেডি’। ২০১১ সালের ১১ জুলাই মিরসরাইবাসীর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক দিন। এ দিনটিকে ভুলতে পারছেন না তারা। কারণ ১১ জুলাই ঘটে যায় স্মরণকালের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা মিরসরাই ট্র্যাজেডি। একসাথে অকালেই ঝরে যায় ৪৫টি তাজা প্রাণ। এটি শুধু মিরসরাইয়ের আলোচিত ঘটনা নয়, যা দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়।
ওইদিন দুপুরে মিরসরাই সদরের স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা দেখে বাড়ি ফেরার পথে বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের পশ্চিম সৈদালী এলাকায় তেতুলতলায় সড়কের পাশের ডোবায় শিক্ষার্থী বহনকারী মিনিট্রাক উল্টে পড়ে ৪২ শিক্ষার্থীসহ ৪৫ জন মারা যান। মুহুর্তেই মিরসরাইসহ সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঘোষণা করা হয় তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক।
পিতার কাঁধে ছিল পুত্রের লাশ, যা একজন পিতার জন্য সবচেয়ে ভারী বস্তু। ছিল মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর গগণবিদারী আর্তনাদ। কেঁদেছে সবাই, কান্না ছাড়া থাকতে পারেনি কেউ। গ্রামের পর গ্রাম খোঁড়া হয়েছিল অসংখ্য কবর। কেউ কাউকে সান্ত¦নাও দিতে পারেনি।
একটা সময় স্বজনহারাদের সান্ত¦না দিতে ছুটে আসেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। স্বজনহারা পরিবারগুলোর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে দলমত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ছুটে আসেন অনেক মানুষ।
মিরসরাই ট্র্যাজেডির ৮ম বার্ষিকীতে অতীতে যেসব প্রতিশ্রুতির বাণী শোনানো হয়েছিল নিহতদের পরিবার-পরিজনদের অদ্যাবধি নিহতদের স্বজনরা সেসব প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবতা খুঁজছে। কিন্তু তা খুঁজে পাচ্ছেন না। হতাশার সুর তাদের কণ্ঠে। বিশেষ করে শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারিকরণের দাবী এবং ১১ জুলাইকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে ঘোষণার দাবি ছিল নিহতদের স্বজন ও সহপাঠীদের।
উপেক্ষিত একাধিক প্রতিশ্রুতি : দুর্ঘটনার পর অনেক মন্ত্রী-এমপি, বহু সংস্থা-সংগঠন শোকে শামিল হতে আবুতোরাব যান। তখন নানা প্রতিশ্রুতি দেন। তবে বহু প্রতিশ্রুতি আজও পূরণ হয়নি। তৎকালীন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার বলেছিলেন, এ ট্র্যাজেডি স্মরণে মিরসরাই স্টেডিয়াম মাঠকে বাস্তব স্টেডিয়ামে পরিণত করা হবে। কিন্তু তা আজ হয়নি। তৎকালীন শিক্ষা সচিব বলেছিলেন, নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিদ্যালয়টিকে সরকারি ঘোষণা করবেন। কিন্তু তা আজও হয়নি।
ট্র্যাজেডিতে নিহতরা : ১১ জুলাই ঘটনাস্থলে নিহতরা হলো তাকিব উল্ল্যাহ মাহমুদ সাকিব, আনন্দ চন্দ্র দাশ, নুর মোহাম্মদ রাহাত, জাহেদুল ইসলাম, তোফাজ্জল ইসলাম, লিটন চন্দ্র দাশ, আরিফুল ইসলাম, উজ্জ্বল চন্দ্র নাথ, তারেক হোসেন, মোহাম্মদ সামছুদ্দিন, মেজবাহ উদ্দিন, ইমরান হোসেন ইমন, কাজল চন্দ্র নাথ, সূর্য চন্দ্র নাথ, ধ্রæব নাথ, সাজু কুমার দাশ, আবু সুফিয়ান সুজন, রুপন চন্দ্র নাথ, সামছুদ্দিন, আল মোবারক জুয়েল, ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, আমিন শরীফ, শরীফ উদ্দিন, সাখাওয়াত হোসেন, রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী, কামরুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, তারেক হোসেন, নয়ন শীল, জুয়েল বড়–য়া, রায়হান উদ্দিন, এসএম রিয়াজ উদ্দিন, টিটু জল দাশ, রাজিব হোসেন, আশরাফ উদ্দিন, জিল্লুর রহমান, জাহেদুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম, আশরাফ উদ্দিন পনির, রায়হান উদ্দিন শুভ, মঞ্জুর মোর্শেদ, সাখাওয়াত হোসেন নয়ন, আনোয়ার হোসেন, হরনাথ দাশ।
শোকার্ত ১১ গ্রাম : এখনও শোকের মাতম কাটেনি উপজেলার খৈয়াছরা, মায়ানী, মঘাদিয়া, সাহেরখালী ইউনিয়নের ১১টি গ্রামে। চারটি ইউনিয়নের ১১টি গ্রামগুলো হচ্ছে মধ্যম মায়ানী, পূর্ব মায়ানী, পশ্চিম মায়ানী, সরকারটোলা, মাস্টারপাড়া, শেখের তালুক, কচুয়া, দরগাহ পাড়া, মঘাদিয়া ঘোনা, মঘাদিয়া, পশ্চিম খৈয়াছরা। মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে মধ্যম মায়ানী গ্রামের সর্বোচ্চ স্কুল ছাত্র নিহত হয়। এ গ্রামের নিহত হয়েছে ১৬ জন স্কুল ছাত্র। এছাড়া আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৪ জন, আবুতোরাব ফাজিল মাদ্রাসার ৩ জন, প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজের ২ জন, আবুতোরাব এসএম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩ জন, ২ জন অভিভাবক ও ১ কিশোর নিহত হয়।
‘আবেগ’ ও ‘অন্তিম’ : মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে মহাকালের তিমিরে হারিয়ে গেছে ৪৫ জন। ঘটনার প্রথম বর্ষপূর্তিতে নিহতদের স্মরণে ২০১২ সালে আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’। ২০১২ সালের ১৯ মে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া ও মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. গিয়াস উদ্দিন। এটি নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ১০ লাখ টাকা। এদিকে দুর্ঘটনাস্থলে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’-এর উদ্বোধন করা হয় ২০১৬ সালের ১৪ মে। স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’ ও ‘আবেগ’-এর নকশা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল কবির। ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
অদম্য অভিভাবক গিয়াস উদ্দিন : তৎকালীন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন যারা বেঁচে ছিলো তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের উন্নত হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে প্রেরণের গুরু দায়িত্বটি পালন করেছিলেন। নিহত শিক্ষার্থীদের লাশ বাড়িতে পৌঁছানোর দায়িত্বটিও পালন করেন তিনি। প্রাথমিকভাবে দাফন-কাফনের জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। সন্তানহারা বাবা-মা, ভাইহারা বোন, স্বজনহারাদের কেবলই পাশে থেকে সান্ত¦না দেন। কখনো তাদের বুকে জড়িয়ে নিয়ে নিজের অন্তরের জমানো দুঃখ-কষ্ট একটু কেঁদে হালকা করে নিয়েছিলেন। আয়োজন করেছিলেন উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে শোকসভা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিহতদের স্বজনদের পাশে থেকেছেন। নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের কল্যাণে গড়ে তোলা হয় সহায়তা তহবিল তাতেও অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে তার। ট্র্যাজেডির ৮ম বার্ষিকীর পূর্বে গত ৯ ও ১০ জুলাই নিহতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিহতদের স্বজনদের খোঁজ খবর নেন তিনি।
এ সময় তার সাথে ছিলেন মায়ানী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম গোলাম সরওয়ার, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন ভূঁইয়া, মিরসরাই পৌরসভার কাউন্সিলর রহিম উল্ল্যাহ, চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুত সমিতি-৩ এর সাবেক পরিচালক দেলোয়ার হোসেন, মিরসরাই ইয়ং এসোসিয়েশন কাতারের সভাপতি শিপন চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা নাছির উদ্দিন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শেখ আব্দুল আউয়াল তুহিন প্রমুখ।
মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, ১১ জুলাই মিরসরাই ট্র্যাজেডি শুধু মিরসরাইয়ের ইতিহাসে নয়, সারা দেশ ও বিশ্ব কাঁপানো একটি দিন। দিনটিকে আমরা আমাদের মাঝে লালন করে ভবিষ্যত জীবনে পথ চলায় সতর্কতা অবলম্বন করবো। এই দিবসটি যেন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়, সেজন্য যা যা করার দরকার আমি তা করে আসছি, ভবিষ্যতেও করবো।
কর্মসূচি : নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে কালো বেজ ধারণ ও শোক পতাকা উত্তোলন, খতমে কোরআন, প্রার্থনা অনুষ্ঠান, শোক র‌্যালি, স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ ও ‘অন্তিম’ এ পুষ্পমাল্য অর্পণ, নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে আলোচনা সভা, নিহতদের আত্মার মাগফেরাত ও সদগতি কামনা করে মোনাজাত ও প্রার্থনা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি।