আগে লক নিজেরে করো তবে দেশকে ডাউন করিতে নাহি হবে!

66

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

জুতা আবিষ্কার পড়ে ভাবতাম, মানুষ কি অত বোকা হয়? করোনা না এলে বুঝতামই না, মানুষ এত গাধা ভিজিয়ে সব বানিয়ে দেয় কাদা। আসলে রবীন্দ্রনাথ মহাদার্শনিক, যা ভাবেন তা’ই সঠিক। রাজা বললেন, পায়ে মাটি কেন লাগবে? তাতেই পন্ডিতরা তাঁদের মুন্ডিত মুন্ড নিয়ে পৃথিবী ঢাকার বন্দোবস্ত করে বসলেন চামড়া দিয়ে। শেষে এক তুচ্ছ মুচী এসে, নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে- বলে রাজার পা দুটি ঢেকে দিল দুখন্ড চামড়া মুড়িয়ে। মন্ত্রী বলে উঠেন, আমারো তা ছিল মনে বেটা জানিল কেমনে, হেহেহেহে?
কর্তাব্যক্তিদের এমনই স্বভাব, নিজে পারেন না, অধীনের কৃতিত্বকে নিজের বলে চালিয়ে দেন। আমাদের স্কুলে একজন স্যার ছিলেন, রোল ১- এর খাতা দেখে আমাদের অংক করাতেন। প্রাইমারী তো, তত বুদ্ধি ছিল না, নইলে রোল ১কে বলতাম অংক ভুল করে আনতে, হেহেহে। রবীন্দ্রনাথ দেখালেন রথী মহারথীগণ যা পারেনা, একজন তুচ্ছ মুচী তা পেরেছে। যা আড়াই হাজার বছর আগে ঈশপও দেখিয়েছেন, মহাপরাক্রমশালী সিংহ যা পারেনি, একটি ক্ষুদ্র ইঁদুর তা করে দেখিয়েছে। সিংহ জালে আটকে গেল ইঁদুর জাল কেটে সিংহকে বাঁচাল, অতএব ক্ষুদ্র বলে অবহেলা করতে নেই। এতক্ষণ বললাম সব বই-পুস্তকের কথা, এবার বাস্তব ঘটনাটা বলি। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে বছর পাঁচেক আগে, সম্ভবত ২০১৫ সালের শিশু জাহেদের কথা। শিশু জাহেদ ঢাকার শাহজাহানপুরে ওয়াসার পাইপের ভেতর পড়ে গিয়েছিল। সমস্ত র‌্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী, ওয়াসা, ফায়ার সার্ভিসের বড় বড় কলাকৌশলীরা সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করেও তাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারল না। শেষে মৃত লাশও উদ্ধার করতে না পেরে রটানো হল, পাইপে কেউ পড়েনি সব ষড়যন্ত্র। অতএব গজব নেমে এল জাহেদের বাপের ভালে। থানায় নিয়ে আটকে তাকে নির্যাতন করা হচ্ছিল নাশকতা উদ্ঘাটনে।
অবশেষে পরদিন বিকালের দিকে তিন অখ্যাত যুবক অতিসাধারণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে কূপ থেকেনিষ্পাপ শিশুর লাশটি তুলে আনল। রক্ষা পেল শিশুর অসহায় বাবা, মিথ্যা হল ষড়যন্ত্র তত্ত¡। আর এভাবে পুরা ঘটনাটা মিলে গেল রবীন্দ্রনাথ ও ঈশপের কিচ্ছার সাথে। এবং এ জায়গায় এসে আর একটি চুটকি বলার লোভ সামলাতে পারছি না। এক ছেলে হিসু করতে বসল, উঠে আর সোজা হতে পারছে না কুঁজা হয়ে গেল। বিষয় কি, বিষয় কি, সবে এত টানাটানি করছে, সিধা হচ্ছেই না। শেষে ডাক্তারের কাছে নেয়া হল, ডাক্তার একটি রুমে ঢুকালেন আর বের করলেন, ছেলে সোজা! বিষয় কি ডাক্তার আমরা এত চেষ্টা করলাম সিধা করতে পারলাম না, আপনি এক মিনিটে ঠিক করে দিলেন? ডাক্তার হেসে; শার্টের বোতামটা প্যান্টের ঘরে মেরে দিয়েছিল, আমি খুলে দিয়েছি, হিহিহিহি। অতএব বুঝা যাচ্ছে অধিক সন্যাসীতে গাজন নষ্ট। অতি বড় ঘরনি ঘর পায় না, অতি বেশী সুন্দরী বর পায় না। অল্প বুদ্ধির পাতে ভাত অধিক বুদ্ধির কপালে হাত। করোনা নিয়ে আজ আমাদের সেই দশা। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাচ্ছেনা, কোন পন্থা নির্ধারণ হচ্ছেনা, একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত, একেক পরিকল্পনা। ফলে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার মাঝে দেশ, কাম আর দাম লয়ে সব হল শেষ। কাম = চিকিৎসা, ত্রাণ, এক নাম্বারে দুশ নাম। দাম = খাদ্য, ঔষধ, মাস্ক, স্যানিটাইজার, স্প্রেগান, ইত্যাদি, হিহিহিহি।
যারা ইতিহাসের ছাত্র তারা নিশ্চয় জানেন সপ্তম শতকের বাংলার মাৎস্যন্যায়ের কথা। সপ্তমের শেষার্ধ ও অষ্টমের প্রথমার্ধ মিলে পুরো একশত বছর ব্যাপী বাংলাজুড়ে চলেছিল নৈরাজ্য ও অরাজকতা। ৭৫০ খৃঃ গোপাল এসে এ জাতিকে উদ্ধার করেছিলেন। আজ করোনা এসে গত তিনমাসে যে অরাজক অবস্থা তৈরী করল দেশে, ভাবছি আবার কোন গোপালের দরকার হয় কিনা মোদের উদ্ধার করতে। না ভেবে উপায় কি? গত ২৪ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হল দেশে, কেউ কেউ আবার সেটিকে লকডাউন বলেছেন। অথচ লকডাউনে দেখলাম সড়কে শত শত মানুষ মারা যেতে, ফলে লকডাউন হল কেমন করে বুঝলাম না, হাহাহাহা। থাক যেভাবেই হোক, আবার দেখি কদিন না যেতেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টস খুলে দেয়া হল, বন্যার জলের মত মানুষের ঢল। সবাই বলছে সেটাই হল কাল, করোনার খানাকে বানিয়েছেমেজবান। তার আগেআরো অনেক কাÐ দেখেছি, না বলাটা নিরাপদ। দেশের এখন বড় সঙ্গিন অবস্থা, বলা হচ্ছে যা, প্রকৃত অবস্থা যা তা। রোগীর সংখ্যা যখন ছিল শতকের ঘরে তখনই দেশ থেকে বিদেশীরা চলে যেতে শুরু করল। আর সেই ঘটনাই বুকে কাঁপন ধরাল, কারণ সে সময় তাদের দেশে রোগী কয়েক লাখ আর মৃত্যু কয়েক হাজার। বুঝলাম ডাল মে কুচ কালা, কিছু গোপন করা হচ্ছে, আর এখন তা পরিষ্কার। আক্রান্তের ঘোষিত সংখ্যার চাইতে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশী, মৃতও অনুরূপ। দুই মাস পার হওয়ার পর দেখা গেল লাভ কিছুই হয়নি ক্ষতি ছাড়া। অতএব সরকার সিদ্ধান্ত নিল লক অফ, মরি-ঝরি যা থাকে। এখানেই অধম বলতে চাই কিছু কথা। করোনা আমাদের দেশে এসেছে যখন তা ছিল অনেক পরে, তার আগে সে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছে। ফলে তা থেকে কিছু শিক্ষা আমাদের নেওয়া উচিৎ ছিল। বলা হয় ঠেকে শিখার চেয়ে দেখে শিখা উত্তম, দুঃখের বিষয় আমরা ঠকেও শিখতে পারিনা। অনুরূপ করোনা বিষয়েও মোরা কিছুই শিখতে পারিনি। উত্তরে বলা হতে পারে ইউরোপ-আমেরিকা পারেনি, আমরা কি করে পারব? এ কথা বলে পার পাওয়া যাবেনা, তারা আমাদের বহু আগে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের দেখে আমাদের কিছু হলেও পূর্বানুমান করা উচিৎ ছিল, যেমন করেছিল ভিয়েতনাম, নিউজিল্যান্ড। নিউজিল্যান্ড তো তাদের গত সোমবারই করোনামুক্ত ঘোষণা করে ফেলেছে। আমাদের উচিৎ ছিল লকডাউন না দিয়ে ১৫ দিনের কারফিউ দেওয়া, এবং তাতে কোন সমস্যা হত না কারণ সবার ঘরে তখন কিছু না কিছু মজুত ছিল। এখন ভেবে লাভ নাই, দুই মাসে সব বিজুত হয়ে গেছে।
অতএব যা হওয়ার তা হয়েগেছে, লকডাউন বা কারফ্যুতে যাওয়ার অবস্থা এখন দেশের নাই। ঘটনা পুরা জুতা আবিষ্কার বা শিশু জাহিদের ঘটনার মত হয়েছে, মহারথীরা সবাই ফেল মেরেছে। দেশ পূর্ণ অরাজকতার মধ্যে পড়েগেছে, সামনে কি হয় একমাত্র আল্লাহই মালুম। যেন এক ম্যাসাকারের পদ ধ্বনী শুনতে পাচ্ছি। বলেছিলাম আবার কোন গোপাল এসে আমাদের উদ্ধার করে কিনা। তেমন কোন সম্ভাবনা এখানে নাই, এখানে যা করার সব নিজেরা করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এসঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে। আর কোন উপায় নাই,করোনাকে সাথে নিয়ে এখন বাঁচা শিখতে হবে। পদ্ধতিটা কিন্তু কঠিন কিছু নয়, অত্যন্ত সহজ একটি পন্থা, মাস্ক পরা, দূরে থাকা, সাবান-পানি সঙ্গে রাখা। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কিছুই আমাদের জন্য হিতকর নয়, সবই ক্ষতিকর। মানুষ যুগ যুগ ধরে চর্চার মাধ্যমে পৃথিবীকে আজ নিজের বশে এনেছে। ভেবে দেখুন তো শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, ঝড়, তুফান, ভূ-কম্পনÑ কিছুই কি আমাদের অনুকূলে? সব আমাদের প্রতিকূলে, সেসব কারণে আমাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা, অথচ আমরা দিব্যি বেঁচে আছি। শীত প্রধান দেশ, যেখানে বরফ পড়ে, মানুষ বাঁচার কথা না, কিন্তু বেঁচে আছে। ঝড়-তুফানে আমরা বাঁচার কথা না, অথচ বেঁচে আছি। কেমনে বেঁচে আছি?
কারণ তাদের আমরা প্রতিরোধ করতে শিখেছি। অনুরূপ করোনাকে আমরা প্রতিরোধ করতে শিখতে হবে। করোনা কিন্তু উক্ত প্রাকৃতিক শক্তিগুলির ন্যায় শক্তিশালী নয় অনেক দুর্বল। উক্ত শক্তিগুলি আমাদের নিজ থেকে আক্রমণ করতে পারে, করোনা কিন্তু তা পারে না। ডেকে না আনলে সে আপনাকে কখনো আক্রমণ করতে পারবে না। ভয়ানক এক আক্রান্ত আর আপনার মাঝে একটি কাপড় বা পলিথিন থাকলে করোনা আপনাকে ছুঁতে পারবে না। যদি না আপনি আক্রান্তকে স্পর্শ করেন, আক্রান্তকে স্পর্শ করা মানে করোনাকে আপনি ডেকে আনা। আর এটি করা থেকে বিরত থাকতে পারলে আপনি মুক্ত, তাই করোনাকে প্রতিরোধ করা অত্যন্ত সহজ। ভেবে দেখুন ডাক্তার, নার্স যারা হাসপাতালে শত শত করোনা রোগীর চিকিৎসা করছেন তারা কিন্তু আক্রান্ত হচ্ছেন না। কারণ তারা স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলছেন, মুষ্টিমেয় যে কজন আক্রান্ত হয়েছেন তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানাতেঅবশ্যই ত্রæটি ছিল। অতএব হাসপাতালে রোগীর মাঝে ডাক্তাররা নিরাপদ থাকতে পারলে, কাজেকর্মে, রাস্তাঘাটে আমরা কেন নিরাপদ থাকতে পারব না? অবশ্যই পারব এবং তারজন্য স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলব। নিজে মানব অন্যকে মানতে উৎসাহিত করব এবং এটিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দান করব।
মুখে মাস্ক, হাতে গøাভস, দূরত্ব মেনে অবস্থান, ভিড়ের মধ্যে পিপিই পরিধান, সাথে থাকবে জীবাণুনাশক সল্যুশান। বাড়ি, গাড়ি, কর্মক্ষেত্র যেখানেই থাকি, যা কিছু ধরি আর যাতে বসি, প্রথমে তাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করব তারপর তা ব্যবহার করব। এভাবে একমাস সবাই মেনে চলতে পারলে করোনা শেষ, রক্ষা পাবে দেশ। করতে হবে না লকডাউন করব সুখে জীবনযাপন, দেশ থাকবে অন করোনা হবে ডাউন। দুঃখের কথা হল, সেদিন অফিস যাওয়ার সময় দেখি রাস্তায় একজন লোক কেশে কেশে কফ ফেলছে। রাগে গায়ে আগুন জ্বলে উঠল কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। যদি আমার গায়ে কাশি মারে, হেহেহেহে। এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীকে তৎপর হতে হবে, তবেই সবে নিরাপদ থাকব ইনশাল্লাহ্।
লেখক : কলামিস্ট