আগুন ঝরা ফাগুন

108

ফেব্রূয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়? বরকতের রক্ত/ হাজার যুগের সূর্যতাপে জ্বলবে এমন লাল যে/ সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!/ প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে ছড়াও ফুলের বন্যা/ বিষাদগীতি গাইছে পথে তিতুমীরের কন্যা…
বাঙালির জীবনের সঙ্গে একুশের চেতনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বাঙালির অস্তিত্বের প্রতিটি কর্মযজ্ঞে একুশের উপস্থিতি অচ্ছেদ্য। সেই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের হাহাকার অচিরেই করুণ-কঠিন হয়ে ভাষার ওপর আঘাত হানলো। বিপন্ন করলো বাঙালির মৌলিক অস্তিত্ব বাংলা ভাষাকে। সংকটের সেই সন্ধিক্ষণে এ দেশের তরুণরা ভাষার দাবিতে নেমে এলো রাজপথে। ভিজে গেলো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রূয়ারির মধ্যদিন। এ কেবল রক্তভেজা একটি
আর্তনাদের নয়, এ এক মহান বলীদান, নিজের ভাষার জন্য অনন্য উৎসর্গ।
একুশে ফেব্রূয়ারি দিনটি সেই থেকেই বাঙালির প্রাণের গভীরে জায়গা করে নিলো, বাঙালি পরিচয়ের পাশাপাশি ভাষা পরিচয়ের এক আখ্যান রচিত হলো।
ফলস্বরূপ, ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত সংকলন ‘একুশে ফেব্রূয়ারি’। যা কি না এতদঞ্চলের বাংলা ভাষায় দিলো এক নতুন মাত্রা। সাহিত্যের পাশাপাশি জনজীবনে এলো নতুন পলির টান, অনাস্বাদিত লবণের ঘ্রাণ। আমাদের পরিচয়ের অংশটি ভাষার সঙ্গে যুক্ত করে দেশভাবনায় উজ্জীবিত হলো। বাঙালির আকাংখার কুসুমটি ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে হতে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেলো। স্বাধীন সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সেই থেকে গৌরবের একটি লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে চলেছে বিশ্বব্যাপী।
আমাদের পতাকা, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত এবং আমাদের মাতৃভাষা মিলেমিশে বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে এক অদম্য জনগোষ্ঠী। তারা আজ সব পারে, তারা আজ ঘুচিয়ে দিতে চায় মালিন্যের চাবি, দারিদ্র্যের অবগুণ্ঠন। একুশ থেকে উৎসারিত এই যে জাতি-চরিত্র, তা আমাদেরকে ভাষা গৌরবের পাশাপাশি দিয়েছে রাষ্ট্রের অধিকার। একুশের অঙ্গীকারে যে জাতির উত্থান, মাতৃভাষার অহংকারে যে জাতির বিস্তার, তার ক্ষয় নেই। মাতৃভাষার অহংকারে যে জাতির বিস্তার, তার ক্ষয় নেই। আমরাই পারি, আমাদের উত্তরাধিকারকে সমুজ্জ্বল রাখতে। আমাদের পরবর্তী বংশধরকে যথাযথ পথে চালিত করতে। চাই শুধু ধারণের প্রকৃত ক্ষমতা প্রবাহিত করার যথার্থ শক্তি।
একুশের চেতনাকে কেন্দ্র করেই ‘একুশের বইমেলা’। একমাসব্যাপী বাঙালির মহামিলনের ক্ষেত্র। দীর্ঘ ১১ মাসের প্রস্তুতি শেষে ফেব্রূয়ারি মাস জুড়ে লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মেলবন্ধনে মিলিত হওয়া। আমাদের রচনার মধ্যদিয়েই আমরা নিত্য-নিত্য উপলব্ধি ও মননের উচ্চতর পর্বে উন্নীত হই। মাতৃভাষার গৌরব নিয়ে, আত্ম-উপলব্ধির দীপ্তি নিয়ে ১৬ কোটি বাঙালির চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলা ভাষাভাষী সারা পৃথিবীর বাঙালি। বইমেলা যেন তার মূলে অবিরাম জল দিয়ে চলেছে। আমাদের বইমেলা, তাই শুধু বেচা-কেনার মেলা নয়, এ আমাদের বন্ধনের মেলা, আমাদের যুক্ততার মেলা। একুশ যা শিখিয়েছে, আমরা তাই ছড়িয়ে দিতে চাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আমরা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠি আপন অহংকারে, একুশের অহংকারে। একুশ দিয়েছে আমাদের উদার আকাশ, অফুরান স্বপ্ন। সংবিধানের অঙ্গীকার ছিল সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন। সেটা শতভাগ বাস্তবায়নের দায় আজও কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা জাতি।