আগুন ঝরা ফাগুন

64

মা, তুই এবার নিজেই তবে বলে দে/ এই একটি শব্দ/ উচ্চারিত এই একটি শব্দ লিখতে কতখানি রক্তের দরকার হয়/ আমার এ দেহের আর কতটুকু রক্তের দরকার হবে/ যখন এ শব্দ আর এই বড় রক্তাক্ত স্বদেশ/ কেউ মুছে ফেলতে পারবে না/ মা; বরকত লিখেছে- মা/ সালাম লিখেছে- মা/ জব্বার লিখেছে- মা/ মতিউর-আসাদ ওরা লক্ষ লক্ষ লিখে গেছে- মা…
পঞ্চাশের দশকের সূচনায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠী যখন ভাষা ও সংস্কৃতিতে নিজের রাজনৈতিক শেকড় ও ঠিকানা খুঁজছিল; পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জনগোষ্ঠী যখন ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা ও রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্বের পরিচয় বেছে নেওয়ার দ্বিধায় ভুগছিল; তখন আসামের বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ, কাছাড় ও হাইলাকান্দি এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গোয়ালপাড়া, বড়পেটা অঞ্চলের বাঙালিদের নামতে হয় অস্তিত্বের লড়াইয়ে। উগ্রপন্থি অহমীয়া জনগোষ্ঠী শুরু করে ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলন। ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা যখন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই করছে, আসামের বাঙালিরা তখন মাতৃভূমি রক্ষার জন্য জীবন বাজি রাখছে; অহমীয়া-বাঙালি বিভাজনের সেই অনাকাঙ্খিত প্রভাব আরও প্রকট হয়ে ওঠে, যখন রাজ্যের জন্য দাপ্তরিক ভাষা নির্ধারণের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে।
১৯৬০ সালের এপ্রিলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি অহমীয়াকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণার দাবি তোলে। বাঙালিরা ব্যক্ত করে তীব্র প্রতিক্রিয়া। কারণ আসামের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে অহমীয়া জনগোষ্ঠী ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালায়। ওই বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ৫০ হাজার বাঙালি উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে হাজির হয় এবং আরও ৯০ হাজার বাঙালি উদ্বাস্তু বরাক উপত্যকায় পালিয়ে যায়। বিচারপতি গোপাল মেহরোত্রাকে নিয়ে গঠিত এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে এক কামরূপেই চার হাজারের বেশি বাড়ি ধ্বংস হয় এবং নয়জন বাঙালি নিহত হন। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় যখন ওই বছরের ১০ অক্টোবর আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলপ্রসাদ চালিহা অহমীয়াকে একমাত্র দাফতরিক ভাষার মর্যাদা দিয়ে প্রাদেশিক বিধানসভায় বিল উত্থাপন করেন। করিমগঞ্জ থেকে নির্বাচিত বাঙালি বিধানসভা সদস্য রণেন্দ্রমোহন দাস এর বিরোধিতা করে বলেন, এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ভাষাকে দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। কিন্তু তার পরও ২৪ অক্টোবর ওই বিল পাস হয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর অহমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ করা হয়। ওই বছর ১৪ এপ্রিল কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে ব্যাপকভাবে পালিত হয় সরকারের অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ‘সংকল্প দিবস’। বরাক উপত্যকায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে ২৪ এপ্রিল শুরু হয় পক্ষকালব্যাপী ‘পদযাত্রা’। এতে অংশগ্রহণকারী ‘সত্যাগ্রহীরা’ তিনশ’ কিলোমিটারেরও বেশি পথ হেঁটে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ভাষার দাবিতে জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ২ মে পদযাত্রা শেষে বরাক উপত্যকার প্রধান শহর শিলচরে সমবেত হয় জনতা। সেখানে বাঙালি নেতা রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন, বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক মর্যাদা দেওয়ার দাবি না মানা হলে ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলবে। গণসংগ্রাম পরিষদ আসামের অন্যান্য ভাষাকেও স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলে। পরিস্থিতির অবনতিতে ১২ মে আসাম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশের সদস্যরা শিলচরে মার্চ করেন এবং যে কোনো গোলযোগের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রশাসন। হরতালের আগের দিন ১৮ মে গণসংগ্রাম পরিষদের তিন প্রধান নেতা রাজনীতিক নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন এবং যুগশক্তি সাপ্তাহিকের সম্পাদক বিধুভূষণ চৌধুরীকে আটক করে আসাম পুলিশ। তারপরও ১৯ তারিখ সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল শুরু হয়। সকাল থেকে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি শহরে পিকেটিং চলতে থাকে। সরকারি দপ্তর রেলওয়ে স্টেশন ও আদালতে পিকেটাররা ঢুকে কাজ বন্ধ করে দেয়। সেদিন শিলচর স্টেশনে একটি টিকিটও বিক্রি হয়নি। বিকেলে আসাম রাইফেলের সদস্যরা স্টেশন এলাকায় প্রবেশ করে। সেখানে জড়ো হওয়া জনতার ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলি চালায়।