আগুন ঝরা ফাগুন

67

ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক/ একটি মিনার গড়েছি আমরা চার কোটি কারিগর বেহালার সুরে রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়/ পলাশের আর রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়/ দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন/ যুগে যুগে সেই শহীদের নাম/ একেছি প্রেমের ফেনিল শিখায়/ তোমাদের নামে তাই আমাদের/ হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে/ শুধু এক শপথের ভাস্কর…/ হে নতুন প্রজন্ম!/ ভুলে যেয়ো না সেইসব কিশোরের কথা/ যারা একদিন কচি গলায়/ বাংলাদেশের সব শহরের রাস্তায় রাস্তায়/ অজস্র কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ ফুলের গন্ধে/ ফুটিয়ে তুলেছিল আরেক রকম রক্ত-লাল-ফুল; ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’…
বাঙালির জাতীয় জীবনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জীবনে বাংলা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান। ওই আন্দোলনের অবিনাশী চেতনা ও বীরত্বপূর্ণ অর্জন বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়েছে যুগপৎভাবে। বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপলক্ষ উদযাপন ও ভাষার উন্নয়নের কাজ করার মানসিকতা তৈরিতেও এ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর একুশ ফেব্রূয়ারিতে মহান ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। একুশের প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করে। গোটা জাতি শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধায় ভাষা শহীদদের স্মরণ করে। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ শোকের প্রতীকস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে। এছাড়া, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তর্পণ এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিনটা কখনো ‘জাতীয় শোক দিবস’ আবার কখনো ‘জাতীয় শহীদ দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। একইসাথে এদিন রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে।ভাষা-শহীদদের আত্মদানের মহিমান্বিত একুশে ফেব্রূয়ারি বর্তমানে ‘শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। বিগত ২০০১ সাল থেকে শহীদ দিবসের সাথে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এদিন রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত টিভি চ্যানেলগুলোতে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে নানা অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করা হয়। অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র। এছাড়া, পুরো ফেব্রূয়ারি মাসজুড়ে থাকে নানা আয়োজন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এটি একুশে বইমেলা নামে সমধিক পরিচিত। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগকারীদের ত্যাগের সম্মানে এ মাসেই ঘোষণা করা হয় দেশের প্রধান রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ ‘একুশে পদক’।
মানুষের মনের গহীনে একুশের আবেগ পৌঁছে দিতে একুশের ঘটনা ও চেতনা নিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র দেশাত্মবোধক গান, নাটক, কবিতা ও চলচ্চিত্র। তন্মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা আন্দোলনের ই্িতহাস ও ঘটনাবলী নানা উপমায় উদ্ভাসিত হয়ে আসছে। এ ধরণের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে আছে, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী রচিত নাটক ‘কবর’ কবি শামসুর রাহমান রচিত কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ এবং ‘ফেব্রূয়ারি ১৯৬৯’ জহির রায়হান রচিত উপন্যাস ‘একুশে ফেব্রূয়ারি’ বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান রচিত ‘আর্তনাদ’। এছাড়া, ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’।
অপরদিকে, বাঙালির ভাষা আন্দোলনের মতই একুশে ফেব্রূয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনও যুগপৎভাবে গৌরব ও অহংকারের। বিগত ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে একুশে ফেব্রূয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করেন। সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারি হাসান ফেরদৌস একই বছরের ২০ জানুয়ারি রফিকুল ইসলামকে এই মর্মে অনুরোধ করেন, তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। ফেরদৌসের কাছ থেকে এমন অনুরোধ শুনেই রফিকুল ইসলাম তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সঙ্গে নিয়ে ‘এ গ্রূপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সংগঠনে একজন করে ইংরেজ, জার্মান, ক্যান্টোনিজ ও কাচ্চিভাষীও সদস্য হন। এরপর ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস্ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর পক্ষ থেকে জাতিসংঘের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি অসংখ্য মানুষ ও সংগঠন এ প্রস্তাবের পক্ষে বিপুল সমর্থন ব্যক্ত করে। এতসব নাটকীয়তার পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে একুশে ফেব্রূয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাব উত্থাপনের পর জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বিশ্বের একশ’ ৮৮টি দেশ ওই প্রস্তাবের পক্ষে তাদের নিরঙ্কুশ সমর্থন প্রকাশ করে। ওই অধিবেশনেই সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রূয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হয়। এভাবেই বাঙালির ‘আগুন ঝরা ফাগুন’ কিংবা ‘একুশে ফেব্রূয়ারি’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে।