আগুন ঝরা ফাগুন

61

ভুলবো না ভুলবো না/ সেই একুশে ফেব্রূয়ারি ভুলবো না/ লাঠি গুলি আর টিয়ার গ্যাস/ মিলিটারি আর মিলিটারি ভুলবো না/ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দাবিতে ধর্মঘট/ বরকত সালামের খুনে লাল ঢাকার রাজপথ…
বাঙালির জাতীয় অর্জনের ইতিহাস বিধৃত হয়েছে সাহিত্য-সাময়িকীতে। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা বায়ান্নের পূর্বে থেকে বাঙালির স্বাধিকার চেতনাকে অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত করেছেন আত্মত্যাগী শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নানাভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে। কালের পরিক্রমায় উত্তরাধিকারের পথ ধরে আসা বাঙালির স্বাধিকার চেতনার অগ্নিমশাল তিতুমীর-ক্ষুদিরাম-বরকত হয়ে তুলে দিয়েছেন নতুন প্রজম্মের হাতে। রক্ত দিয়ে মুক্ত বাতাস কেনার অবিনাশী চেতনায় ভর করে এগিয়ে চলেছে স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথেও চট্টগ্রাম জড়িয়ে আছে আপন মহিমায়। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি অনুযায়ী চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ৪ ফেব্রূয়ারি প্রথম সর্বদলীয় সভা আহব্বান করা হয়। সভায় ছাত্র-যুবক-সংস্কৃতিসেবী-শ্রমিক-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আলোচনার পর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। পরিষদের প্রথম সভাতেই বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু-এ তিন ভাষায় পোস্টার লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় তরুণ সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী আহব্বায়ক এবং রেলওয়ে শ্রমিক লীগ নেতা চৌধুরী হারুনুর রশীদ ও আওয়ামী মুসলিম লীগের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ যুগ্ম আহব্বায়ক নির্বাচিত হন। কমিটিতে এ ছাড়া ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ ও শ্রমিক নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মোজাফফর আহমেদ ও মুসলিম লীগের এককালীন নেতা আমির হোসেন দোভাষ, আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা ডা. আনোয়ার হোসেন, জেলা মুসলিম লীগের একাংশের নেতা আজিজুর রহমান ও তমদ্দুন মজলিসের নেতা আজিজুর রহমান। বিভিন্ন ক্লাব ও যুব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন কৃষ্ণগোপাল সেনগুপ্ত (কালাচাঁদ)। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিসেবীদের মধ্য থেকে শামসুদ্দিন আহমদ, তৎকালীন গণতন্ত্রী দলের অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম, রুহুল আমিন নিজামী (উদয়ন পত্রিকার সম্পাদক) সুধাংশু ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও মহল্লা সর্দার শামসুদ্দিন জগলু, দোকান-কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা মনীন্দ্র মহাজন ও সুনীল মহাজন, তৎকালীন ছাত্রনেতা এমদাদুল ইসলাম ও আবু জাফর, ডা. সৈয়দুর রহমান, ডা. নুরুল আজিম, ডা. সরোজ দে প্রমুখ। পরে এই সংগ্রাম পরিষদকে আরও বর্ধিত করা হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদে কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় তাদের সরাসরি কোন প্রতিনিধি ছিল না। জেলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক গোপাল বিশ্বাস কমিউনিষ্ট পার্টি ও সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
এছাড়া, সভায় বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু-এ তিন ভাষায় পোস্টার লেখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উর্দুভাষী কুশলী পোস্টার লেখার কর্মীও এসে জোটে। কর্মীরা বুকে কালোব্যাজ লাগিয়ে রেয়াজুদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ এলাকা থেকে দু’আনা এক আনা করে চাঁদা তুলে পার্টির অফিসে জমা দিত। এ দিয়েই মাইক ও পোস্টারের খরচ চলত। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে প্রচার কাজের জন্য প্রথমেই বের হন ওবায়দুল হক ও চকবাজারের সালেহ আহমদ। কর্মীরা ‘অ’ ‘আ’ ‘ক’ ‘খ’ বর্ণ লিখে তা নিয়ে মিছিল বের করত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রচার-স্কোয়াডগুলো পথসভা করে সংক্ষিপ্ত ভাষণে রাষ্ট্রভাষার দাবি সাধারণ জনতার কাছে তুলে ধরত। রাতের খাওয়া সেরে গণতন্ত্রী দল আর যুবলীগের কর্মীরা পোস্টার লাগাতে বের হত।