আগুন ঝরা ফাগুন

45

ও আমার মায়ের মুখের মধুর ভাষা কতই অহংকারে/ জড়িয়ে আছো ছড়িয়ে আছো সুরের অলংকারে/ তুমি আকাশ নীলে ভাটির টানে/ রাখাল কিষাণ মাঝির গানে/ জীবন হয়ে আছো জেগে উতল বীণা তারে/ ও আমার বুকের ভাষা সজীব আশা নয়ন ভরা আলো/ ও আমার কণ্ঠ ভূষণ অরূপ রতন ভালোবাসার ভালো/ তুমি অবুঝ প্রাণের করুণ ব্যথা/ সবুজ মনের আকুলতা/ তোমার ছোঁয়ায় উতল হয়ে যাচ্ছে বারে বারে…
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রূয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ভাষা-শহীদদের জানাজা শেষে বিশাল মিছিল বের করা হয়। সেদিন আইন
পরিষদে বিরোধীদলের সদস্যরা বিষয়টি উত্থাপন করেন। তারা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে এবং অধিবেশন মুলতবি করার ঘোষণা দিতে আহব্বান জানান। ক্ষমতাসীন দলের কিছু সদস্যও এই আহব্বানে সমর্থন জানান। কিন্তু নুরুল আমিন তাদের আহব্বানে সাড়া না দিয়ে অধিবেশন অব্যাহত রাখেন এবং হাসপাতালে যেতে অস্বীকৃতি জানান। রতখন সারা দেশ হয়ে উঠে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল। জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি শোক পালন করতে থাকে। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শহরের নাগরিক সমাজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। পরে তাদের অংশগ্রহণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে উপস্থিত সকলে বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণ করে। বেলা ১১টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে পুলিশ তাদের সরিয়ে
দেয়ার চেষ্টা করে এবং একপর্যায়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। ওই ঘটনায় সরকারি হিসেবে চারজন নিহত হয়। শহরের বিভিন্ন অংশে একইভাবে জানাজা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন কলেজ, ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজন এই মিছিলে অংশ নিতে আসে। বিকেলে আরেকটি বিশাল মিছিল পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিক্ষুদ্ধ জনতা সরকার পক্ষের প্রথম সারির দু’টি সংবাদপত্র জুবিলী প্রেস এবং মর্নিং নিউজ অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। একই দিনে পুলিশ দ্বারা আক্রমণ ও হত্যার বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। নবাবপুর রোডের বিশাল জানাজার মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিবর্ষণে শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারি শফিউর রহমান, ওয়াহিদুল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল। একই রাস্তায় অহিদুল্লাহ নামে নয় বছরের এক বালকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। জনশ্রুতি রয়েছে, পুলিশ বেশকিছু লাশ কৌশলে সরিয়ে ফেলে।
বায়ান্ন’র ২১ ও ২২ ফেব্রূয়ারির ঘটনার পর সরকার আন্দোলনের বিপক্ষে জোরালো অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, কমিউনিস্ট ও পাকিস্তানবিরোধীদের প্ররোচণায় ছাত্ররা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। তারা বিভিন্নভাবে তাদের এই অপপ্রচার অব্যাহত রাখে। সারাদেশে প্রচারপত্র বিলি করে। সংবাদপত্রগুলোকে তাদের ইচ্ছানুসারে সংবাদ পরিবেশনে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। পাশাপাশি ব্যাপক হারে সাধারণ জনগণ ও ছাত্র গ্রেপ্তার অব্যাহত রাখে। ২৫ ফেব্রূয়ারি শহীদ আবুল বরকতের ভাই একটি হত্যা মামলা দায়ের করার চেষ্টা করলে উপযুক্ত কাগজের অভাব দেখিয়ে সরকার মামলাটি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। রফিকউদ্দিন আহমদের পরিবার একই ধরণের একটি প্রচেষ্টা নিলে, একই কারণে তাও বাতিল হয়। ৮ এপ্রিল সরকার তদন্ত শুরু করে। কিন্তু সরকারি প্রতিবেদনে মেডিকেল কলেজে ছাত্রদের উপর গুলি করার কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ দেখাতে পারেনি তদন্ত কমিটি। সরকারের প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ প্রত্যাখান করে। ১৪ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এ সমস্যা নিরসনের পক্ষে অনেক সদস্য মত প্রকাশ করলেও মুসলিম লীগের সদস্যরা এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ের বিপক্ষে তারা ভোট দিলে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে তারা ২১ ও ২২ ফেব্রূয়ারির ঘটনার পর গণপরিষদে বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। ২৭ ফেব্রূয়ারি বার সেমিনার হলে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ একটি সেমিনার আহব্বান করে এবং সরকারের কাছে ২১ দফা দাবি উত্থাপন করে। ১৬ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে ছাত্ররা সমাবেশ করে।