আগুন ঝরা ফাগুন

61

বাঙালির অস্তিত্বের প্রতিটি কর্মযজ্ঞে একুশের উপস্থিতি অবিচ্ছেদ্য। সেই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের হাহাকার যেন অচিরেই করুণ-কঠিন হয়ে ভাষার ওপর আঘাত হানল। বিপন্ন করল বাঙালির মৌলিক অস্তিত্ব বাংলা ভাষাকে। সংকটের সেই সন্ধিক্ষণে এ দেশের তরুণরা ভাষার দাবিতে নেমে এলো রাজপথে। বুকের তাজা লাল রক্তে ভিজে গেল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রূয়ারির মধ্যদিন। এ কেবল রক্তভেজা একটি আর্তনাদের ইতিহাস নয়, এ এক মহান আত্ম-বলিদান, মায়ের ভাষার জন্য অনন্য উৎসর্গ। একুশে ফেব্রæয়ারি দিনটি সেই থেকেই বাঙালির প্রাণের গভীরে জায়গা করে নিল। বাঙালি পরিচয়ের পাশাপাশি ভাষা পরিচয়ের এক আখ্যান রচিত হল। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল আলোচিত সংকলন ‘একুশে ফেব্রূয়ারি’। যা কি না এতদাঞ্চলের বাংলা ভাষায় এক নতুন মাত্রা উপহার দিয়েছে। সাহিত্যের পাশাপাশি জনজীবনে এলো নতুন পলির টান, অনাস্বাদিত লবণের ঘ্রাণ। আমাদের পরিচয়ের অংশটি ভাষার সঙ্গে যুক্ত করে দেশভাবনায় উজ্জীবিত হল। বাঙালির আকাক্সক্ষার কুসুমটি ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে
হতে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেল। স্বাধীন সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সেই থেকে গৌরবের একটি লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে চলেছে বিশ্বব্যাপী।
স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং মাতৃভাষা মিলেমিশে বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে এক অদম্য জনগোষ্ঠী। আজ তারা সব পারে! তারা আজ ঘুচিয়ে দিতে চায় মালিন্যের চাবি, দারিদ্র্যের অবগুণ্ঠন। একুশ থেকে উৎসারিত এই যে জাতি-চরিত্র, তা আমাদেরকে ভাষা গৌরবের পাশাপাশি দিয়েছে রাষ্ট্রের অধিকার। একুশের অঙ্গীকারে যে জাতির উত্থান, মাতৃভাষার অহংকারে যে জাতির বিস্তার, তার ক্ষয় নেই। মাতৃভাষার অহংকারে যে জাতির বিস্তার, তার ক্ষয় নেই। আমরাই পারি, আমাদের উত্তরাধিকারকে সমুজ্জ্বল রাখতে। পরবর্তী বংশধরকে যথাযথ পথে চালিত করতে। চাই শুধু হৃদয়ে ও মননে ধারণক্ষমতা প্রবাহিত করার যথার্থ শক্তি।
একুশের চেতনাকে কেন্দ্র করেই ‘একুশের বইমেলা’। একমাসব্যাপী বাঙালির মহামিলনের ক্ষেত্র। দীর্ঘ ১১ মাসের প্রস্তুতি শেষে ফেব্রূয়ারি মাসজুড়ে লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মেলবন্ধনে মিলিত হওয়া। আমাদের রচনার মধ্য দিয়েই আমরা নিত্য উপলব্ধি ও মননের উচ্চতর পর্বে উন্নীত হই। মাতৃভাষার গৌরব নিয়ে, আত্ম-উপলব্ধির দীপ্তি নিয়ে ১৬ কোটি বাঙালির চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলা ভাষাভাষী সারা পৃথিবীর বাঙালি। বইমেলা যেন তার মূলে অবিরাম জল ঢেলে চলেছে। বইমেলা তাই শুধু বেচা-কেনার মেলা নয়, এ আমাদের বন্ধনের মেলা, আমাদের যুক্ততার মেলা। একুশ যা শিখিয়েছে, আমরা তাই ছড়িয়ে দিতে চাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আমরা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠি আপন অহংকারে, একুশের অহংকারে। একুশ দিয়েছে আমাদের উদার আকাশ, অফুরান স্বপ্ন। আমাদের সংবিধানের অঙ্গীকার ছিল সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করা। আমরা কি তা পালন করছি? এই অবহেলা ও অক্ষমতাকে আর কতদিন প্রশ্রয় দেয়া যায়?