আগুন ঝরা ফাগুন

141

মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা/ মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা/ কি যাদু বাংলা গানে, গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে/ গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা/ বিদ্যাপতি, চÐী, গোবিন্দ, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন/ ঐ ফুলেরই মধুর রসে বাঁধলো সুখে মধুর বাসা/ বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগৎ জিনে/ তোমার চরণ-তীর্থে আজি, জগৎ করে যাওয়া-আসা/ ঐ ভাষাতেই নিতাই-গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা/ আছে কই এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি নাশা/ ঐ ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে ‘মা, মা’ বলে/ ঐ ভাষাতেই বলবো হরি, সাঙ্গ হলে কাঁদা-হাসা…
বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে বাংলা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান। বাঙালি জাতির মধ্যে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপলক্ষ
উদযাপন ও ভাষার উন্নয়নের কাজ করার মানসিকতা তৈরিতে এ আন্দোলনের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘মাতৃভাষা দিবস’ বা ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে এবং একইসাথে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।
এছাড়া ফেব্রæয়ারি মাসটি আরো নানাভাবে উদযাপিত হয়। যার মধ্যে আছে, মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদযাপন, যা একুশে বইমেলা নামে সমধিক পরিচিত। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগকারীদের ত্যাগের সম্মানে এ মাসেই ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’। মানুষের ভেতর একুশের আবেগ পৌঁছে দিতে একুশের ঘটনা ও চেতনা নিয়ে রচিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকার দেশাত্মবোধক গান, নাটক, কবিতা ও চলচ্চিত্র। তন্মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব সূচিত হয়ে আসছে। রচনাগুলোর মধ্যে আছে – শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী রচিত নাটক কবর; কবি শামসুর রাহমান রচিত কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ এবং ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’; জহির রায়হান রচিত উপন্যাস ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’; বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান রচিত ‘আর্তনাদ’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। ২১ ফেব্রæয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইউনেস্কোর কাছে লিখিতভাবে প্রস্তাব করে, যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সংস্থার ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে পাশ হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার দু’বছর পর ১৯৫৪ সালে নিহতদের স্মরণে নতুন একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সহযোগিতায় বড় পরিসরে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করা হয়। নতুন শহীদ মিনারের স্থপতি ছিলেন হামিদুর রহমান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল চত্বরে বড় আকারের এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। মূল বেদির উপর অর্ধ-বৃত্তাকারে সাজানো ৫টি স্তম্ভের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, মা তার শহীদ সন্তানদের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের কারণে স্থাপনাটির নির্মাণ কাজের অগ্রগতি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের মা হাসনা বেগম শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এটি ভেঙ্গে দেয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার এটি পুনরায় নির্মাণ করে।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়াও ভারতের আসাম রাজ্যে বাংলা ভাষাকে সমমর্যাদা দেয়ার লক্ষ্যে আন্দোলন হয়েছিল। ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর রেলস্টেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য দাবি জানালে পুলিশের গুলিতে ১১ জন বাঙালি শহীদ হন। পরবর্তীতে আসামের বাংলাভাষী লোকসংখ্যা বেশি রয়েছে এমন তিনটি জেলাতে বাংলাকে আধা-সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে।