আগুনঝরা মার্চ

30

যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে/ যে দেশেতে কলমি কমল কনক হয়ে হাসে/ সে আমাদের জন্মভূমি মাতৃভূমি বাংলাদেশ/ যে দেশেতে পাজরা পানশি উজান ভাটি চলে/ যে দেশেতে মাঝি-মাল্লা নতুন কথা বলে/ সে আমাদের জন্মভূমি মাতৃভূমি বাংলাদেশ/ যে দেশেতে নদ-নদীরা এক সাগরে মিশে/ আমরা সবাই নিত্য খুশি সে দেশ ভালোবেসে/ যে দেশেতে কাঙ্খের কলসি নদীর ঘাটে আসে/ যে দেশেতে খুশির জোয়ার সকল বারো মাসে/ সে আমাদের জন্মভূমি মাতৃভূমি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ…
একাত্তরের সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরই স্বাধীনতা অর্জনের যাবতীয় কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। আর এই ভাষণের দিনেই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত
চূড়ান্তরূপে গৃহীত হয়। বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় সঙ্গীত চূড়ান্ত করার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন।
সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু ফ্রস্টকে বলেন, ‘সাতই মার্চ যখন আমি ঢাকা রেসকোর্স মাঠে আমার শেষ মিটিং করি, ওই মিটিংয়ে উপস্থিত দশ লাখ লোক দাঁড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানকে স্যালুট জানায় এবং ওই সময়ই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত চূড়ান্তরূপে গৃহীত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘আমি জানতাম কি ঘটতে যাচ্ছে, তাই আমি সাতই মার্চ রেসকোর্স মাঠে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করেছিলাম, এটাই স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য যুদ্ধ করার মোক্ষম সময়।’ ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিট ফ্রস্টের সাথে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার, বাংলাদেশ ডক্যুমেন্টস দ্বিতীয় খন্ডে বিস্তারিত বিবরণ আছে।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের সাথে যেমন আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তেমনি সাথে সাথে তিনি কতগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড ওর্য়াকও করে যাচ্ছিলেন। সাতই মার্চের পর তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাহকে তার কাছে ডেকে পাঠান। তিনি তার সাথে বৈঠক করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারা এ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। বৈঠকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমেদও উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীনতার দলিল অষ্টম খÐের ২২ থেকে ২৩ পৃষ্ঠায় এ বৈঠকের কথা উল্লে­খ আছে। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু নুরুল উল্লাকে একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করে দেয়ার কথা বলেন। ওই ট্রান্সমিটারে তিনি শেষবারের মত ভাষণ দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘নুরুল উল্লাকে আমি বললাম, আমাকে ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতেই হবে। আমি যাবার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। তুমি আমায় কথা দাও, যেভাবেই হোক একটা ট্রান্সমিটার আমার জন্য তৈরি রাখবে। আমি শেষবারের মত ভাষণ দিয়ে যাব।’
ড. মোহাম্মদ হান্নান এ ব্যাপারে তার ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকের পর নুরুল উল্লা সঙ্গে সঙ্গে এসে বার্তাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিক্ষকদের বলেন। শুরু হয়ে যায় স্বাধীন বাংলার প্রথম রেডিও ট্রান্সমিটার তৈরির কাজ। বিভাগীয় প্রধান ড. জহুরুল হকসহ প্রায় সকল শিক্ষক নয় দিন কাজ করার পর একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করেন। এর স¤প্রচার ক্ষমতা বা শক্তি ছিল প্রায় গোটা বাংলাদেশব্যাপী। শর্ট ওয়েভে-এর শব্দ ধরা যেত।
অন্যদিকে, আব্দুল কুদ্দুস মাখন তার একটি সাক্ষাতকারে বলেছেন , ১৯৭০ সালেই বঙ্গবন্ধু আখাউড়া শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি লালমিয়া ও গঙ্গাসাগরের রফিককে একটি রেডিও স্টেশন স্থাপন বিষয়ে যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে খোঁজখবর করার জন্য ভারতে পাঠিয়েছিলেন। তাদের ওই মিশনের প্রাক-কাজকর্ম স্বাধীন বাংলার প্রথম বেতার কেন্দ্র স্থাপনে সহায়ক হয়েছিল।
এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন’ গ্রন্থে বলা হয়, মার্চের প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র সংগ্রামের সমূহ সম্ভাবনা দেখতে পান । ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও কর্নেল ওসমানী প্রথম আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা করে এ সংক্রান্ত খুঁটিনাটি দিক প্রস্তুত করেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক অফিসারও এ সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে গোপনে দেখা করেন।