আগুনঝরা মার্চ

110

একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল/ আমাকে তুই বাউল করে, সঙ্গে নিয়ে চল/ জীবন মরণ মাঝে, তোর সুর যেন বাজে/ একটি কথা আমি শুধু বলে যেতে চাই/ বাংলা আমার সুখে-দুখে হয় যেন গো ঠাঁই রে/ প্রাণের প্রিয় তুমি, মোর সাধের জন্মভূমি/ একটি গানই আমি শুধু গেয়ে যেতে চাই/ বাংলা আমার, আমি যে তার/ আর তো চাওয়া নাই রে/ তোমায় বরণ করে, যেন যেতে পারি মরে…
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে এই দিনে জয়দেবপুরে (বর্তমানে গাজীপুর) পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর গোটা বাঙালি জাতি যখন স্বাধিকার আন্দোলনে উত্তাল, ঠিক তখনই জয়দেবপুরের কৃষক শ্রমিক ছাত্রসহ সর্বস্তরের মানুষ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ
গড়ে তুলেছিল। জনতার মুখে মুখে
শ্লোগান ছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ঊনিশে মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার জয়দেবপুরে বীরত্বপূর্ণ নানা ঘটনা সংঘটিত হয়।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ঊনিশে মার্চ জয়দেবপুরে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির অতুলনীয় শৌর্য-বীর্য ও বীরত্বের অমলিন গৌরব গাঁথার এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। শুধু ১৯ মার্চ নয়, একাত্তরের মার্চে টঙ্গী শিল্প এলাকায় পাক হানাদার বাহিনী মার্চের ৫, ৬, ১৫, ১৭ ও ১৮ মার্চসহ বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক-জনতার উপর আক্রমণ ও গুলি বর্ষণ করে। একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও এর পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশ ছিল মিটিং মিছিল আর আন্দোলনের এক উত্তাল তরঙ্গ। ঊনিশে মার্চ জয়দেবপুরের মাটিতেই শুরু হয় হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে বীর বাঙালির প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে একাত্তরের পয়লা মার্চ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। স্লোগানে-স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। সেই ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে জয়দেবপুর ও আশপাশের এলাকায়। তৎকালীন সরকারি কর্মকর্তা আহমদ ফজলুর রহমানের বাসায় জয়দেবপুর এলাকার আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ডাকে অনুষ্ঠিত এক সভায় গঠিত হয় সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ।
এই পরিষদে হাইকমান্ড এবং এ্যাকশন কমিটি নামে দুটি কমিটি ছিল। হাইকমান্ডে ছিলেন মো. হাবিবউল্যাহ, ডা. মনীন্দ্রনাথ গোস্বামী ও এম. এ. মোত্তালিব। এ্যাকশন কমিটিতে ছিলেন আ. ক. ম. মোজ্জাম্মেল হক (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী), নজরুল ইসলাম খান (বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য), মো. নুরুল ইসলাম (মাস্টার), মো. আয়েশউদ্দিন, মো. আবদুস সাত্তার মিয়া, মো. শহীদুল্লাহ বাচ্চু, শেখ আবুল হোসাইন, মো. হারুন-আর-রশীদ ভুঁইয়া ও মো. শহীদুল্লাহ পাঠান। এছাড়াও ডা. সাঈদ ভুঁইয়া, আবুদল বারিক মিয়া, মো. হযরত আলী, চৌধুরী গিয়াস উদ্দিন, মো. আবদুল বারী, নূরুল আনোয়ার, মো. হাবিবুর রহমান, জামাল হায়দার, মো. শহীদউল্লা, খুরশীদ হোসেন নয়ন, ইয়াকুব আলী সরকার, কাজী আলিমউদ্দিন, রফিকুর রহমান, মো. রমিজউদ্দিন, মো. হাতেম আলী প্রমুখ সেই সময়ের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এদের অনেকেই ইতিমধ্যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
এদিকে, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হবার পর এলাকায় প্রতিরোধযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় সমরাস্ত্র কারখানা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ও ডিজেল প্ল্যান্টের শ্রমিক-কর্মচারীরাও আন্দোলনে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করে। ৫ মার্চ রথখোলার বটতলায় এক জনসভায় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া, সাতই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য ট্রেন ও বাসে জয়দেবপুর থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী যোগ দেন। জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়িতে (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। এ রেজিমেন্টে ২৫/৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি ছাড়া সবাই ছিলেন মনে-প্রাণে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদুল হাসান খান এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর এম. শফিউল্লাহ। এ ছাড়াও ছিলেন আরো কয়েকজন বাঙালি অফিসার। এরা হলেন, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম, ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন এজাজ আহমদ চৌধুরী প্রমুখ।