আগুনঝরা মার্চ

52

ঠিক যেখানে দিনের শুরু অন্ধ কালো রাত্রি শেষ/ মন যতদূর চাইছে যেতে ঠিক ততদূর আমার দেশ/ এই কাটাতার জঙ্গী বিমান এই পতাকা রাষ্ট্র নয়/ দেশ মানে বুক আকাশ জোড়া ইচ্ছে হাজার সূর্যোদয়/ এ মানচিত্র জ্বলছে জ্বলুক এই দাবানল পোড়াক চোখ/ আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক…
বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টারা শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ১৯৭১ সালে ২৪ মার্চ পুনরায় বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু ততক্ষণে শান্তির প্রতিষ্ঠার সুযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কারণ, কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। একাত্তরের মার্চে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, তিনি এবং বাংলাদেশের জনগণ আরোপিত কোন সমাধান মেনে নেবেন না। তিনি বলেন, জনগণের দাবি ভূলুণ্ঠিত করার কোন চক্রান্ত সফল হবে না। কোন শক্তির কাছে আমরা মাথা নত করবো না। আমরা বাংলাদেশের জনগণকে মুক্ত করবোই। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ আরেক বিবৃতিতে গণবিরোধী শক্তির চক্রান্ত রুখে দিতে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত এবং সতর্ক থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহব্বান জানান।
এদিকে, জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য পাকিস্তানি প্রশাসন থেকে ঢাকায় গুঞ্জন ছড়ানো হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ভুট্টো ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থান করেন। আর চট্টগ্রামে মেজর জিয়াউর রহমান এবং তার সহযোগিরা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর মেজর রফিককে পাকিস্তানিদের ওপর আগাম আক্রমণ করার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করার আহব্বান জানান। মেজর জিয়া বলেন, পাকিস্তানিরা কোন ভুল করবে না। রফিকের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে বহু মানুষ নিহত হবে।
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ ঢাকায় এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে কোন আরোপিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, কোন আরোপিত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণ সহ্য করবে না। তিনি বলেন, আমাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত এবং পরিষ্কার। এ দাবি মেনে নিতে হবে। তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনের সামনে সমবেত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাবেশে তিনি আরো বলেন, জনগণ সতর্ক এবং ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। পৃথিবীতে কোন শক্তি নেই, তাদের দাবিকে দাবিয়ে রাখার। কারো রক্তচক্ষু এদেশের জনগণ মেনে নেবে না। শেখ মুজিব বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু তারা তা চায় না। আমাদেরকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমি আশা করি, কেউ সে অপচেষ্টা চালাবেন না। শেখ মুজিব আরো বলেন, লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের জনগণ মুক্ত এবং তাদের অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত থাকবে। তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধেও সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন। তিনি আন্দোলনে শৃংখলা বজায় রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহব্বান জানান। তিনি বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে আন্দোলনকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে। তারা সহিংসতার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি সৈয়দপুরে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
তিনি সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেন, এ ধরনের অপচেষ্টা বাংলার জনগণ ব্যর্থ করে দেবে। কারণ, বাংলাদেশের জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। চক্রান্ত করে আর জনগণের আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। শেখ মুজিব আরো বলেন, কেউ আমার মাথা কিনতে পারবে না। অন্যরা শহীদদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, কিন্তু আমি করতে পারবো না। জনগণ শহীদদের রক্তকে ব্যর্থ হতে দেবে না। তিনি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার এবং যে কোনও পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকার আহব্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, লড়াই জোরদার করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি জীবিত থাকবো কি-না। কিন্তু আপনাদের অধিকার আদায়ে আপনাদেরকে অবশ্যই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ তিনি শক্তি প্রয়োগ ও দমন নীতির কাছে মাথা নত না করে তা প্রতিরোধ করার জন্য জনগণের প্রতি আহব্বান জানান। জনতার মুহুর্মূহ করতালির মধ্যে তিনি ঘোষণা করেন, তিনি বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে আর দাসত্বের মধ্যে রাখতে দেবেন না। তিনি আরো বলেন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে অগণিত মানুষ মারা গেছে। আমরা বাঙালির এই মৃত্যুর মিছিলের অবসান ঘটাতে চাই। তিনি চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে জনগণের প্রতি আহŸান জানিয়ে বলেন, ‘আমি যদি নির্দেশ নাও দিতে পারি,সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত করতে আপনারা দৃঢ় সংকল্প নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবেন।’