আগুনঝরা মার্চ

46

চাষাদের, মুটেদের, মজুরের/ গরিবের, নিঃস্বের, ফকিরের/ আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের/নেই ভেদাভেদ হেথা চাষা আর চামারে/ নেই ভেদাভেদ হেথা কুলি আর কামারে/ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান/ দেশ মাতা এক সকলের/ লাঙলের সাথে আজ চাকা ঘোরে এক তালে/ এক হয়ে মিশে গেছি আমারা সে যে কোন কালে/ মন্দির, মসজিদ, গীর্জার আবাহনে/ বাণী শুনি একই সুরের…
একাত্তরের ঐতিহাসিক মার্চের শুরু থেকেই বঞ্চিত-শোষিত বাঙালি জাতি ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন করে রাজপথে। হরতাল কর্মসূচি দমানোর কৌশল হিসেবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সান্ধ্য আইন জারি করলেও বাঁধভাঙার মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালির কাছে তা ধোপে টেকেনি। পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে মুক্তির লক্ষ্যে অবিচল বাঙালির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে কুখ্যাত পাকিস্তানি বাহিনীও বসে থাকে নি। কারফিউ দিয়েও সামরিক জান্তা সাহসী বীর বাঙালিদের ঘরে আটকে রাখতে না পেরে গোপনে আঁটতে থাকে নির্মম ও নিষ্ঠুর কায়দায় বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা। আর অপেক্ষা করতে থাকে ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান কী বলেন তা শোনার জন্য।
এদিকে, আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা দফায় দফায় বৈঠকে বসেন সাতই মার্চের জনসভা সফল করার জন্য। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) চলতে থাকে জনসভার প্রস্তুতি। পাশাপাশি ঢাকাসহ সারাদেশেই গঠন হতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্র নেতারা কোমর বেঁধে গোপনে নানা উৎস থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকেন। অধিকার আদায়ের দাবিতে বিক্ষুব্ধ বাঙালির মিছিলে মিছিলে ঝাঁঝালো শ্লোগানে উচ্চকিত ছিল সারাদেশ। সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’ একাত্তরের উত্তাল ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই দিনে সারাদেশের সকল পাড়া, গ্রাম, মহল্লায় সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি শান্তি-শৃংখলা রক্ষা কমিটি এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের আহবান জানানো হয়। এর উদ্যোক্তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যান্টিনে স্থাপন করা হয় ছাত্রদের যোগাযোগ কেন্দ্র। এদিন খুলনায় বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। হরতাল চলাকালে খুলনায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে ছয়জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে দু’দিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় একশ ২১ জনে। ঢাকায় আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় হরতালে দমন-পীড়নের নিন্দা জানানো হয়। লাগাতার হরতালে ঢাকাসহ সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে।
ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নেত্রী কবি সুফিয়া কামাল ও মালেকা বেগম যৌথ বিবৃতিতে ছয় মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের আহবান জানান। এদিন ঘটে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। এই ঘটনা চলমান আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। যা বাঙালির মুক্তির পথকে সামনের দিকে আরও এগিয়ে নেয়। এছাড়া, এদিন বঙ্গবন্ধুর আহবানের পর স্বাধিকার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষু বীর সংগ্রামীদের প্রাণ রক্ষার্থে শত শত নারী-পুরুষ ও ছাত্র-ছাত্রী ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। সে এক অভূতপূর্ব মানবিক দৃশ্য! জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন এক বিবৃতিতে বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসেনি। তিনি ঔপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহবানে সাড়া দেয়ায় বাংলার সর্বস্তরের জনগণকে অভিনন্দন জানান। তিনি বাঙালি জাতিকে ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দু’টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা তখনও পর্যন্ত বেতন পাননি, শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
অন্যদিকে, করাচী প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। আর পিডিপি প্রধান নূরুল আমিন ঢাকায় এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহবান করার দাবি জানান।