আগুনঝরা মার্চ

91

তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা/ গঙ্গার স্রোত ধরে পেয়েছি চলার নিশানা/ কন্ঠের সুর কোনও মানে না ভাষা/ হৃদয়ের ভাষাতেই মেটে পিপাসা/ সাত মহাসাগরের উজানে ভেসে/ আমরা যেখানে থামি সেই সীমানা/ যেখানে কান্না আর রক্ত মেঘে/ আঁধারের বাঁধ ভেঙে সূর্য ওঠে আকাশে আবার/ সেখানে নিশানা আছে এগিয়ে যাবার/ যখন আখের স্বাদ নোন্তা লাগে/ লবঙ্গ বনে ঝড়ের হাওয়ারা জাগে/ এক বুক ভালবাসা উজাড় করা/ যেখানে ফসল ফলে প্রাণের সোনা…
বিচারকের চেয়ারে বসে যিনি হুকুম বা আদেশ দেন, তিনিই তো হাকিম। কথায় বলে, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। একাত্তরে বাঙালি জাতি সেই হাকিমের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আর একাত্তরের সাতই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে পরাধীনতার শৃংখলমুক্তির নেশায় পাগল বাঙালি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রকৃত অর্থেই হাকিমের মতোই বললেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রূর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। সাত কোটি মানুষকে দাবাইয়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের ডুবাতে পারবে না।’ এর মধ্য দিয়েই পাল্টে যায় তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের দৃশ্যপট। বাঙালি জাতি প্রস্তুতি নিতে শুরু করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের।

মাত্র ১৯ মিনিটের একটি অলিখিত ভাষণ। সবমিলিয়ে এক হাজার ৯৯ শব্দের এ এক অভাবনীয় উচ্চারণ। এই স্বল্প সময়ে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন স্বাধীনতার স্থপতি একজন মানুষ কিংবা নেতা জাতির কত কাছের ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব হলেই কেবল হাকিম হয়ে হুকুম করেন। বাঙালির সবচেয়ে বিশ্বস্থ ও ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত ‘তুমি’ সম্বোধনেই বঙ্গবন্ধু জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম সাহসী উচ্চারণ, সম্বোধনে, শব্দচয়নে ও বজ্রকণ্ঠে আর কোন নেতাকে ভাষণ দিতে শোনা যায়নি। এর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু পরিণত হয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিতে। আর তাঁর অমর ভাষণটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদা লাভ করে। যা রাজনীতির চৌকাঠ পেরিয়ে কাব্যে-গল্পে-ছড়ায়-সাহিত্যে গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়। এ কেমন ভাষণ। যার অমিত তেজি সম্মেহনী শক্তি সাতকোটি বাঙালিকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিল। প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন দিতেও কার্পণ্যবোধ করেনি। বঙ্গবন্ধুর এই বজ্রনিনাদে আসন্ন মহামুক্তির আনন্দে বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাক্সিক্ষত মুক্তির লক্ষ্যে। বাঙালি জাতিসত্ত¡া, জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয়, তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের করার সংকল্পবদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্যদিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

একাত্তরে মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর জঘন্যতম গণহত্যা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতা। বহু পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও তাই মনে করতেন। সেসময় পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত একটি বুকলেটে ইন্দোনেশিয়া ও জার্মানির রক্তপাতের কথা উল্লেখ করে মুখবন্ধে বলা হয়, ‘পাকিস্তান দখলদার বাহিনী কর্তৃক মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) গণহত্যা, পূর্ববর্তী সব গণহত্যার ভয়াবহতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।’
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান ফোরাম নামে একটি সংগঠন ‘ইস্টবেঙ্গল : রুটস অব দি জেনোসাইড’ নামে একটি বুকলেট প্রকাশ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরাই মূলতঃ সংগঠনটি গঠন করেন। বাংলাদেশিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্যাতনের বিষয়টি বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবহিত করতে পূর্ব বাংলার বন্ধুদের সহায়তায় ৮০ পৃষ্ঠার বুকলেটটি তারা প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের ভেতরে ও বাইরে বসবাসকারী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিকসহ বহু পাকিস্তানি স্বাধীনতা-যুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। আর এজন্য তাদের অনেককেই জেল, জুলুম ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করে কবিতা লেখার দায়ে পাকিস্তানের কবি আহমেদ সেলিম ও হাবিব জালেবকে অমানবিক নির্যাতন ও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। একই সময়ে যুদ্ধকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন মাজহার আলী খান, তাহেরা মাজহার ও আজগর খানসহ অনেক পাকিস্তানি। আজগর খান বিবৃতি দেয়ায় তার ছেলেকে সর্বোচ্চ এ নির্যাতন করা হয়। তার ছেলে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। যুদ্ধের প্রতি জনসমর্থন ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আকর্ষণের জন্য পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা ‘পাকিস্তান ফোরাম (পিএফ)’ গঠন করেন। এর লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ কেন হচ্ছে- তা বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবহিত করা। এর সম্পাদক ছিলেন ফিরোজ আহমেদ। তিনি ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেন। একাত্তরে আমেরিকানরাও একটি সংগঠন তৈরি করেন। নাম দেন ‘ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল’। এর সদর দপ্তর ছিল নিউইয়র্ক। একজন পাকিস্তানি গবেষক ইকবাল আহমেদ। তিনি ছিলেন বিহারী। একাত্তরের ১০ এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমস-এ তার ও তার তিন বন্ধুর একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠিতে পাকিস্তানি জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়।