আগুনঝরা মার্চ

43

অগ্নিঝরা মার্চের ২৪ তারিখ জাতীয় ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যার প্রস্তুতির দিন। এই দিনে ক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাকাসহ সারাদেশ। এই দিনেই একদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পরামর্শক দল প্রহসনের আলোচনা চালাচ্ছিল, অন্যদিকে নির্বিচারে গণহত্যার ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল পাক সামরিক জান্তা। বাঙালি ভাবতেও পারেনি মাত্র একদিন পর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ বিভীষিকাময় রাত।
২৪ মার্চ রাতে ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে পাক হানাদার বাহিনীরা। এদিকে আলোচনার নামে প্রহসনে ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু পাক সামরিক জান্তার উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামিকালের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালি নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে’। চট্টগ্রামে যখন বাঙালিদের হত্যার জন্য অস্ত্র নামানো হচ্ছিল, তখন ঢাকায় ইয়াহিয়ার পরামর্শকরা বৈঠক করছিলেন আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে।
আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সামরিক জান্তার পক্ষে আলোচনায় অংশ নেন এম এম আহম্মদ, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। সকালে ও সন্ধ্যায় দু’দফা বৈঠক চলে। বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, ইয়াহিয়ার কাছে দাবি জানালে কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না। ‘বল এখন প্রেসিডেন্টের কোর্টে’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একাত্তরের এই দিন করাচী থেকে সোয়াত নামক একটি জাহাজ আসে। এতে ৫ হাজার ৬৩০ টন অস্ত্র আনা হয়। অস্ত্র নামাতে গিয়ে বাঙালি শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাক হানাদার সামরিক অফিসারদের মুখের ওপর শ্রমিকরা অস্ত্র নামাতে অস্বীকৃতি জানায়। অবরোধ করে রাখে জাহাজটিকে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী শ্রমিক।
একাত্তরের ২৪ মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা একে একে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের সব নেতাই এ দিন কারাচীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ভুট্টোর সফরসঙ্গী ১৩ জনের ৭ জনই এদিন ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৩ মার্চ রাত হতে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলগাড়ি, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে একশ’ নিহত এবং এক হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। গত দিনের মতো এদিনও সারা বাংলাদেশে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল পতপত করে। ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তান রাইফেলসের যশোর ট্রাংক রোডের অফিসেও এদিন উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
এদিকে ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান থেকে খান আবদুল কাইয়ুম ঢাকায় আসেন। কাইয়ুম ঢাকা আসার পরই ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে তিনি সর্বদা নমনীয় ও আন্তরিক মনোভাব পোষণ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান বাস্তবিকই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। কিন্তু এমন আলোচনার আড়ালে যে বিভীষিকাময় গণহত্যার ষড়যন্ত্র সামরিক জান্তা করছিল, তা বাঙালি জাতির কাছে ছিল ধারণারও বাইরে।
একাত্তরের এই দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ভবনে বিভিন্ন সময়ে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামিকালের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। পাক সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাশত করা হবে না।
২৪ মার্চের সেই গোপন পরিকল্পনারই বহি:প্রকাশ ঘটায় পাক সরকার। তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে, ঘরে ঘরে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে হত্যা করে অগণিত বাঙালিকে। যা আজও কালোরাত্রি এবং গণহত্যার রাত হিসেবে পরিচিত।