আগুনঝরা মার্চ

59

জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো/ এমন করে আকুল হয়ে/ আমায় তুমি ডাকো/ তোমার কথায় হাসতে পারি/ তোমার কথায় কাঁদতে পারি/ মরতে পারি তোমার বুকে/ বুকে যদি রাখো মাগো/ তোমার কথায় কথা বলি/ পাখির গানের মতো/ তোমার দেখায় বিশ্ব দেখি/ বর্ণ কত শত/ তুমি আমার খেলার পুতুল/ আমার পাশে থাক মাগো/ তোমার প্রেমে তোমার গন্ধে/ পরাণ ভরে রাখি/ এইতো আমার জীবন-মরণ/ এমনি যেন থাকি/ বুকে তোমার ঘুমিয়ে গেলে/ জাগিয়ে দিও নাকো মাগো…
মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার ক’দিন আগে যুদ্ধের সূচনালগ্নে একাত্তরের ২৩ মার্চই পাকিস্তান রাষ্ট্রের কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হয়। তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানে তখনও পাকিস্তানি পতাকা উড়ছিল। এসময় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারা দেশে ‘জাতীয় পতাকা দিবস’ পালিত হয়। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
ঘর-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আহবান জানানো হয়। এই অভাবনীয় ঘটনা কৌশলগতভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়কে অবশ্যম্ভাবী ও অপরিহার্য করে তোলে। দিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটেও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ১৯৪০ সালের এই দিনে লাহোর প্রস্তাব পাস হয় এবং পাকিস্তান এই দিনটিকে ‘জাতীয় দিবস’ হিসাবে পালন করে। কিন্তু, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একে প্রত্যাখ্যান এবং এই দিনটিকে ‘প্রতিবাদ দিবস’ হিসাবে আখ্যায়িত করে।
একাত্তরের ২৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক লাখ লোকের সশস্ত্র কুচকাওয়াজের আয়োজন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তত্ত¡াবধানে গঠিত ‘জয় বাংলা বাহিনী’। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু একটি পিস্তলের গুলি ছুঁড়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। তিনি তখন ‘জয় বাংলা বাহিনী’র নেতা ছিলেন। পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ সঙ্গীতটিও বাজানো হয়। এরপর পল্টন থেকে রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্রসহ পূর্ণ সামরিক কায়দায় বের করা সশস্ত্র মিছিলটি পল্টন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় যায়। দেশের সব বাড়ি ও অফিসের মত বঙ্গবন্ধুর বাসায়ও সেদিন বাংলাদেশের একটি পতাকা উত্তোলন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বাদে প্রায় সব কনস্যুলেট অফিসেও বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। সেদিনের বাস্তবতায় পিস্তলের গুলি ছোঁড়া এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ছিল একটি দুঃসাহসিক কাজ। কেননা, তখনও সেটা ছিল পাকিস্তান। চরম ঝুঁকি উপেক্ষা করেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে সেদিন মুক্তিকামী লাখো বাঙালি বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়িয়েছিল।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলী ভূট্টোর সঙ্গে চলমান আলোচনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করেন। এরপর ভুট্টো এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম গ্রুপ)-এর খান আবদুল কাইয়ুম খান ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন। বৈঠকের পর ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি স্বায়ত্তশাসন নয়, সার্বভৌমত্বের দাবি। তাই তিনি এটা প্রত্যাখ্যান করলেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী) এই দিনটিকে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ এবং অন্যান্য পেশাজীবী, নারী ও বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি পালন উপলক্ষে সারাদেশে মিছিল করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এটি ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। একাত্তরে বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু’র প্রাক্কালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতা- বহু পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীও এমনটাই মনে করতেন। ইন্দোনেশিয়া ও জার্মানির রক্তপাতের কথা উল্লেখ করে একটি বুকলেট-এর মুখবন্ধে বলা হয়, ‘তবে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী কর্তৃক মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) গণহত্যা পূর্ববর্তী সব গণহত্যার ভয়াবহতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।’ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান ফোরাম নামে একটি সংগঠন ‘ইস্টবেঙ্গল : রুটস অব দ্য জেনোসাইড’ নামে একটি বুকলেট প্রকাশ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা সংগঠনটি গঠন করেন। বাংলাদেশিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্যাতনের বিষয়টি বিশ্ব স¤প্রদায়কে অবহিত করতে পূর্ব বাংলার বন্ধুদের সহায়তা করতেই ৮০ পৃষ্ঠার বুকলেটটি প্রকাশ করা হয়।