আখেরী চাহার শোম্বা ও মহানবী (দ.)’র গোসল

579

পারস্য সাগরের পূর্ব দিকের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মানুষ আরবি সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরী চাহার শোম্বা হিসেবে পালন করে। এইদিনের গোসল ছিল মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে শেষ গোসল। এই দিনে নবীজী রোগ হতে মুক্ত হয়ে গোসল করেন। এরপর আবার মহানবী (দ.)’র রোগগ্রস্ত হয় এবং আস্তে আস্তে রোগ বৃদ্ধির কারণে রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তেকাল করেন। এইদিনের স্মরণে মুসলমানগণ দোয়া দরূদ লিখে পানিতে ডুবিয়ে সে পানি দ্বারা গোসল করেন, নতুন কাপড় পরিধান করে সুগন্ধী লাগায় শরীরে। ইসলামে এই গোসলের তাৎপর্য ও ফজিলত রয়েছে।
মাহবুবে খোদা ছরকারে দো-আল হযরত মোহাম্মদ (দ.)’র তেষট্টি বছর হায়াতে জিন্দেগীতে কোনদিন বড় ধরনের রোগ হয়নি। কাফের মুশরিক পৌত্তলিকদের কতশত অত্যাচার অবিচারের মাঝেও শরীর মোবারক দুর্বল হয়নি। জীবনের বিদায় বেলায় মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ১১ হিজরীর সফর মাসে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এতে সাহাবায়ে কেরাম এবং নবীজীর সম্মানিত স্ত্রীগণ বিচলিত হয়ে পড়েন। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। এইদিন সকালে মহানবী (দ.) উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) কে ডেকে বললেন, আমার জ্বর কমে গেছে, আমাকে গোসল করাও। তিনি তাঁকে গোসল করিয়ে দিলেন। মহানবী (দ.) গোসলের সময় সাত মশক পূর্ণ (যেন কোন মশকে পানি অপূর্ণ না থাকে) পানি তাঁর শরীর মোবারকে ঢেলে দিতে বলেছিলেন। হযরত আয়েশা (রা.) সাত মশক পানি দিয়েই নবীজীকে জীবনের শেষ গোসল করালেন। এরপর তিনি সুস্থ হন।


মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) জীবনের শেষ গোসল করার পর তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.), হযরত ঈমাম হাসান (রা.), হোসাইন (রা.) সহ সকলকে নিয়ে সকালের নাস্তা করেন। হযরত বেলাল (রা.) এবং সাহাবীগণ প্রিয় নবী (দ.)’র রোগ মুক্তির কথা মদিনাবাসীর ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিল। দলে দলে সাহাবায়ে রাসূলগণ নবীজীর দরবারে হাজির হলো এবং আনন্দ প্রকাশ করলো। মুসলমানদের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেল দান-খয়রাত সদকা। শুকরিয়া জ্ঞাপন করা হলো মহান আল্লাহ পাকের দরবারে। আমিরুল মোমেনিন খলিফাতুন মোসলেমিন হযরত ওমর ফারুক (রা.) গরীব মিসকিনদের প্রদান করলেন ৭০০০ দিরহাম, খুশিতে হযরত আবু বকর (রা.) প্রদান করলেন ৫০০০ দিরহাম, মওলা আলী (রা.) দান করলেন ৩০০০ দিরহাম। নবীজীর ধনী সাহাবী হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) রাসূল (দ.)’র প্রেমে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করেন একশত উট। প্রিয় নবী (দ.)’র একটুখানি কল্যাণ, একটুখানি আরামের বিনিময়ে সাহাবায়ে কেরাম জান-মাল উৎসর্গ করতে পারে এটি আমাদের জন্য চিরকালের আদর্শ। এসব ঘটনা আমাদের ঈমানকে মজবুত করে। এসব ঘটনায় আমাদের জন্য আছে শিক্ষণীয় আদর্শ। আমাদের আত্মস্থ হয়, ভোগ নয় ত্যাগই আছে মুক্তি। ত্যাগ যদি মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবিবের জন্য হয় তাহলে ঘটবে মহামুক্তি।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতেন তাঁর বিদায়ে সময় কখন। ছয় মাস পূর্ব হতেই তিনি বিদায়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। প্রত্যেক রমজান মাসের শেষ দশদিন তিনি ইতিকাফ করতেন। প্রতি রমজান মাসে হযরত জিব্রাইল (রা.) নবীজীর নিকট আগম করে পুরো পবিত্র কোরআন একবার শুনাতেন এবং নবীজীও তাঁকে পুরো কোরআন জিব্রাইলকে একবার শুনাতেন। তাঁর বিদায়ের পূর্বে জীবনের শেষ রমজান হযরত জিব্রাইল আল্লাহর রাসূল (দ.) কে পুরো কোরআন শুনালেন দুইবার এবং নবীজীও শুনালেন দু’বার। আল্লাহর রাসূল (দ.) জীবনে হজ করেছিলেন একবার। নাম বিদায় হজ। বিদায় হজের ভাষণে তিনি ঘোষণা করলেন, আজকের এইদিনে আমি তোমাদের সাথে মিলিত হয়েছি। হয়তো আর তোমাদের সাথে এখানে কোনদিন মিলিত হতে পারবো না। অতঃপর আরাফাতের ময়দানে অবতীর্ণ হয় পবিত্র কোরআনের মহাবাণী, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ইসলাম) কে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদা, আয়াত-৩)
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ হওয়া মানে আল্লাহর রাসূল (দ.) সফল। এই সফলতার বাণীপ্রাপ্তিতে হযরত ওমর ফারুক (রা.) খুশিতে উল্লাসিত হলেন কিন্তু আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কান্না করতে লাগলেন। তাঁর কারণ জানতে চাওয়া হলো, এই সফলতার দিনে কেন আপনি কান্না করেছেন! তিনি জানালেন, আল্লাহর রাসূলের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে ইসলাম পূর্ণতার মাধ্যমে। তিনি আর দুনিয়াতে থাকবেন না, তাই কান্না করছি।
এসব ঘটনার মাধ্যমে আত্মস্থ হয় যে, নবীজী তাঁর বিদায়ের কথা জানতে এবং সাহাবায়ে কেরামগণ তাঁর ইঙ্গিত বুঝবে পারতেন। মাহবুবে খোদা ছরকারে দো-আলম হযরত মোহাম্মদ (দ.) ইন্তেকালের পূর্বে ওহুদের প্রান্তরে হাজির হলেন। যেখানে শুয়ে আছেন নবীজীর প্রাণপ্রিয় চাচা ইসলামের বীরযোদ্ধা হযরত আমির হামজা (রা.) এবং সত্তর জন জান্নাতি সাহাবী। নবীজী তাঁদের কবর জিয়ারত করলেন। এরপর গেলেন জান্নাতুল বাকির কবরস্থানে যেখানে শায়িত আছে হাজার হাজার সাহাবায়ে রাসূল (দ.)। এখানে কবরবাসিদের উদ্দেশ্যে বললেন, আসসালামু আলাইকুম ইয়া দারু কওমি মু’মিনিন…। হে আসল নিবাসের অধিবাসী মুমিনগণ! আমি অতি শীঘ্রই তোমাদের সাথে মিলিত হবো। এরপর হযরত জিব্রাইল ফেরেস্তা এসে নবীজীকে জানাল যে, মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আপনাকে তাড়াতাড়ি দুনিয়া হতে চলে যাওয়ার অথবা থাকার অনুমতি প্রদান করেছেন। আপনি যেটা গ্রহণ করেন। প্রিয় নবীজী অন্যান্য নবীদের পথ অনুসরণ করে দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণের সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছিলেন। মহানবী (দ.) ইন্তেকাল করেছেন, আমাদেরকেও ইন্তেকাল করতে হবে। ইন্তেকাল করা সুন্নাত। যে সুন্নাত সকলের জন্য নির্ধারিত। কেউ চাইলেই এই সুন্নাতে রাসূল হতে পালাতে পারবে না।
আখেরী চাহার শোম্বার মাধ্যমে নবীজীর এসব ঘটনাসমূহ হতে যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতাম তাহলে আমাদের সমাজ রাষ্ট্র পরিবর্তন হতো। আখেরী চাহার শোম্বার শিক্ষা গ্রহণ করে রাসূল (দ.)’র প্রতিটি সুন্নাত পালনপূর্বক তাঁর রেজাবন্দি হাসিল করতে পারি। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন…

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক