আক্রান্ত ১৫ হাজার

55

প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, সঙ্গে বেড়েছে বিস্তার; দেশের ৬৪টি জেলার ৬৩টিতেই এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্তরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ গত ২৪ ঘণ্টায় আরও এক হাজার ৩৩৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছেন ৯৭৪ জন। নতুনদের নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৩৬৯ জন, যাদের আটজনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এবার বর্ষার শুরুতেই ঢাকায় মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটে, এখন বিভিন্ন জেলা থেকে আক্রান্তের খবর আসছে।
মঙ্গলবার দেশের ৬৩টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যেখানে আগের দিনও ৫০ জেলায় ডেঙ্গ রোগীর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছিল তারা।
বিভিন্ন জেলায় আক্রান্তদের অনেকে ঢাকা থেকে রোগ নিয়ে গেছেন। তবে রাজধানীর বাইরেও এডিস মশার বিচরণ রয়েছে বলে স্থানীয় পর্যায়ে আক্রান্তের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া ঢাকা থেকে এই রোগ নিয়ে যাওয়ায় সারা দেশেই তা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। খবর বিডিনিউজের
ডেঙ্গ নিয়ে নতুন করে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২২১ জন ভর্তি হয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, বর্তমানে এখানে চিকিৎসাধীন আছেন ৬৭৯ জন ডেঙ্গ রোগী। এরপর মিটফোর্ড হাসপাতালে নতুন ভর্তি ১০৫ ও চিকিৎসাধীন ২৯৯ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৪৮ ও চিকিৎসাধীন ১২১ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৬১ ও চিকিৎসাধীন ২৬৬ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৪২ ও চিকিৎসাধীন ২১৬ জন, বারডেম হাসপাতালে নতুন ভর্তি ১৭ ও চিকিৎসাধীন ৫২ জন, বিএসএমএমইউতে নতুন ভর্তি ২৬ এবং চিকিৎসাধীন ৯৬ জন, পুলিশ হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৩৩ এবং চিকিৎসাধীন ১৩২ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৬৩ এবং চিকিৎসাধীন ২৫৩ জন, বিজিবি হাসপাতালে নতুন ভর্তি দুই জন এবং চিকিৎসাধীন ৩০ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৯০ এবং মোট চিকিৎসাধীন আছেন ২৪৭ জন।
ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ডেঙ্গণ রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এসব জেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গণ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ১০৪ জন, তাদের নিয়ে মোট চিকিৎসাধীন আছেন ১৯১ জন।
এরপর খুলনা বিভাগে নতুন ডেঙ্গ রোগী ৫৬ এবং মোট চিকিৎসাধীন ১৫১ জন, রাজশাহী বিভাগে নতুন ৫৬ জন এবং মোট চিকিৎসাধীন ১৯৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে নতুন ৫৫ জন এবং মোট চিকিৎসাধীন ১০৪ জন, সিলেট বিভাগে নতুন ৫৫ এবং মোট চিকিৎসাধীন ৭০ জন, রংপুর বিভাগে নতুন রোগী ২০ এবং মোট চিকিৎসাধীন ৮৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে নতুন রোগী নয়জন এবং মোট চিকিৎসাধীন ২৫ জন, বরিশাল বিভাগে নতুন শনাক্ত ছয়জন এবং মোট হাসপাতালে ভর্তি ২৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, ময়মনসিংহ জেলা বাদে দেশের অন্য সব জেলায় ডেঙ্গ রোগী শনাক্ত হয়েছে।
ডেঙ্গু তদারকিতে মন্ত্রীর দপ্তরে সেল গঠন :
ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা কার্যক্রম তদারকিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক তার নিজের দপ্তরে ‘মিনিস্টার মনিটরিং সেল’ গঠন করেছেন। এই সেল থেকে ডেঙ্গু রোগ সংক্রান্ত জনভোগান্তি নিরসনে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চলমান কর্মকাÐ তদারকি করা হবে বলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, ডেঙ্গু রোগ পরীক্ষার ফি সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনার লংঘন হলে তার অভিযোগ গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ‘মিনিস্টার মনিটরিং সেল’।
এই সেলের আওতায় ডেঙ্গণ নিয়ে যে কোনো অনিয়ম সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এজন্য হটলাইন নম্বরগুলো হল: ০১৩১৪-৭৬৬০৬৯/ ০১৩১৪-৭৬৬০৭০, ০২-৪৭১২০৫৫৬/০২-৪৭১২০৫৫৭।
এর আগে সোমবার বিকালে মন্ত্রণালয়ের এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডেঙ্গু ও বন্যাজনিত কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের লক্ষণ ও উপসর্গ পাল্টে আরও মারাত্মক হয়েছে। কারও জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, ডেঙ্গু ধরা পড়লে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং এমনকি রোগ সারার পরেও সজাগ থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু বাংলাদেশে প্রথম দেখা দেয় ২০০০ সালে, সে সময় এই রোগে মারা যান ৯৩ জন। তিন বছর পর থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার কমতে থাকে এবং কয়েক বছর এতে মৃত্যু শূন্যের কোটায় নেমে আসে।
তবে গত বছর আবার ব্যাপকভাবে দেখা দেয় ডেঙ্গু, ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ২৬ জনের মৃত্যু হয় সরকারি হিসাবে। আর এ বছর সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সাত হাজার ৭৬৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টি মশা সাধারণত পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। বাড়ির ভেতরেও বিভিন্ন উৎসে এডিস মশা জন্মায়। এছাড়া বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনের জলাধার, লিফটের নিচে জমে থাকা পানি, ফুলের টব, টায়ার-টিউবসহ যেসব জায়গায় পানি জমে, সেগুলোই এডিস মশার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলা
স্বাস্থ্য বিভাগের
ছুটি বাতিল
সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করেছে সরকার। একই সঙ্গে অন্যান্য বিভাগের কর্মীদের এবার ঈদুল আজহার ছুটি নেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধ, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা ও গুজব প্রতিরোধ সংক্রান্ত একটি পর্যালোচনা সভায়’ এসব সিদ্ধান্ত হয়।
সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঈদের ছুটি তো একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তারপরও আমরা ঈদের ছুটি সকল কর্মকর্তাকে ঢাকায় উপভোগ করার জন্য উৎসাহিত করছি এবং ছুটি না নেওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করেছি। খবর বিডিনিউজের
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছুটি ক্যান্সেল করা হয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য বিভাগে যেসব কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট, তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। আশা করব আমাদের প্রশাসনের কর্মকর্তারা যথাসম্ভব ঢাকাতেই ঈদ করবেন এরকম একটা নির্দেশনা।
সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে সভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাস ও কর্মস্থল পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে বলে জানান সচিব।
আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে, নিঃসন্দেহে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য সরকারি যে সকল অফিস-আদালত আছে, আমাদের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তারা নিজ নিজ উদ্যোগে কর্মস্থল এবং আবাসন, এই সকল জায়গায় যেহেতু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়..সেগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা যাবে বলে জানান শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা তিন হাজার ৮৪৭ জন। এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৭৩৭ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন নয় হাজার ৭৪০ জন। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিন হাজার ৮৪৭ জন।
সভায় উপস্থিত স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের দেওয়া তথ্য তুলে ধরে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যের সংখ্যা আটজন।
তবে কিছু আশঙ্কাজনক কিছু রোগী থাকায় মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে মহামারী ঘোষণা করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যখন একেবারেই ম্যানেজমেন্টের বাইরে চলে যায়, এ রকম পর্যায়ে এখনও আসেনি। কোনো স্থানে ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে গেছে, এরকম কোনো তথ্য নেই।
ডেঙ্গু মোকাবেলায় চিকিৎসকের স্বল্পতার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, যেসকল চিকিৎসক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে আছেন, তাদের প্রশিক্ষণ বাতিল বা স্থগিত করে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত করা হবে। হাসপাতালে জায়গা ও বেডের স্বল্পতা দূর করতে যেসব হাসপাতাল এখন ব্যবহার হচ্ছে না সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্কাউটের সমন্বয়ে ঢাকা দক্ষিণ এবং উত্তরে টিম গঠন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও গুজব ছড়ানোর বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরিপত্র জারি করা হয়েছে বলে সভায় জানিয়েছেন শিক্ষাসচিব। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তাদের অফিস এবং আবাসস্থল পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা রাখবেন।
ডেঙ্গু চিকিৎসার ফি নিয়ে কথা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে মুজিবুর রহমান বলেন, সাধারণ ডেঙ্গুর ইনভেস্টিগেশন যেটা হয় সেটা অনেক বেশি, দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এটা কমিয়ে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা এবং মোট এক হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এটা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার।
দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসককে ডেঙ্গু, গুজব, বন্যা নিয়ে যথাযথভাবে প্রতিকার বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনেক আগেই প্রশাসনের সকল স্তরে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। বন্যা পরিস্থিতি ইতোমধ্যে উন্নতি হচ্ছে সব জায়গায়। এখন পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, বলেন ভারপ্রাপ্ত সচিব শেখ মুজিবুর রহমান।