আইন-মোবাইল কোর্ট দিয়ে ‘নিরাপদ খাদ্য’ সম্ভব নয়

50

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে সরকারি পদক্ষেপের কারণে মানুষ অনেকটা সচেতন হয়েছে। তবে আমরা যদি নিজেরা খাবার ভেজাল করতে না চাই, তাহলে কখনো ভেজাল হবে না। আমাদের মনস্তাত্তি¡ক পরিবর্তন করতে হবে আগে। তারপরে ভেজালবিরোধী অভিযান সফল হবে। কারখানার শ্রমিক, ফুটপাতের ছোট বিক্রেতা থেকে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান সর্বক্ষেত্রে ভেজালের বিরুদ্ধে আরো সচেতনতা সৃষ্টি করে সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। নিজের ঘর থেকে নিরাপদ খাদ্য অভিযান শুরু করতে হবে।
গতকাল বুধবার নগরীর মোটেল সৈকতের কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) ও বিভাগীয় প্রশাাসন আয়োজিত ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ বাস্তবায়নে জনসচেতনতা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
সেমিনারে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, নিরাপদ খাদ্যের জন্য সকল পেশাজীবীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রতিটি ঘরে ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে নিজেরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ মানুষকে নিরাপদ খাদ্য কী-তা বোঝাতে হবে। তিনি বলেন, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, ইমাম প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানুষকে সচেতন করলে সুফল পাওয়া যাবে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এক মিনিট মাদক ও এক মিনিট নিরাপদ খাদ্য, ইমাম তার খুৎবায় এক মিনিট মাদক ও এক মিনিট নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে বললে এ প্রচেষ্টা সফল হবে। এছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেন। ফেসবুকসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। এনজিওকর্মীরা তাদের ঋণের কিস্তি আদায়কালীন সময় উঠান বৈঠকে বাড়ির গৃহিনীদের এ বিষয়ে সচেতন করতে পারেন। এভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হবে।
সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, এক সময় বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ছিল। সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সে ঝুঁকি আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এখন আমরা নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে কাজ করছি। খাদ্যে ভেজাল রোধে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এ উল্লেখিত শাস্তি শুধু নয়, এর বিরুদ্ধে দÐবিধিতে নির্দিষ্ট শাস্তির পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ এ মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে মোবাইল কোর্ট অভিযান জোরদার করতে তিনি এ সময় সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
সেমিনারে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, জনমত তৈরিতে মিডিয়া গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিডিয়া চাইলে অনেক কিছু করতে পারে, দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানাতে পারে। তাই প্রথমে মিডিয়াকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তারাই অন্যান্যদেরকে সচেতন করবে।
খাদ্য সচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা নিজেরা সচেতন হলে হবে না। নিজের বাড়ির কাজের লোকের পরিবেশও নিরাপদ করতে হবে। নইলে তার রান্না করা অনিরাপদ খাবারই নিজের ঘরে খেতে হবে। কাজেই নিজেদের মতোই তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এভাবে তাকে শিক্ষা দিতে হবে, যাতে তার পরিবারেও সে শিক্ষাটি প্রদান করতে পারে।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং সরকারের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সারওয়ার জাহান বলেন, খাদ্যে ভেজালে যারা জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা কোনও ব্যবসায়ীকে কষ্ট দিতে চাই না। আবার দুষ্কৃতিকারীকে ছাড়ও দিতে চাই না। অপরাধ করলে আমাদেরকে জানাবেন সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খাদ্যে ভেজাল নিয়ে যেকোনও সমস্যা বা অভিযোগ নাগরিক সেবা নম্বর ৩৩৩ তে জানাতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, একসময় খাদ্য অধিদপ্তরে নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন না। আনসার দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হতো। এখন আমি পুলিশ আর র‌্যাবকে বলে দিয়েছি যাতে যেকোনও প্রয়োজনে আমাদেরকে সহায়তা করে। তারাও আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সরকারের অতিরিক্ত সচিব ড. নাজমানারা খানুম বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ আর স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কীভাবে তৈরি করতে হবে তা জানা জরুরি। সামান্য ভুলের কারণে আমরা বিপদ ডেকে আনি। যেমন সময়মত হাত না ধোঁয়ার কারণে ডায়রিয়াসহ নানা কঠিন রোগে আক্রান্ত হই। আবার খাদ্য উৎপাদনে আমরা বালাই নাশক ব্যবহার করি। কোন বালাই নাশক কোন শস্যে ব্যবহার করতে হবে না জেনে সব জায়গায় একই বালাই নাশক ব্যবহার করি। ফলে শস্যটি বিষক্রিয়ায় পরিণত হয় এবং খাদ্যের গুণাগুণটি আর থাকে না।
তিনি বলেন, আমরা নিজেরাই সচেতন হই। দায়িত্বটা আমাদের একার নয়, সবাই নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হলেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারবো।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য একেএম নুরুল আফসার বলেন, বিশ্বে প্রতি বছর ১০ জনে ১ জন অনিরাপদ খাদ্য দ্বারা সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ আক্রান্ত হয় ডায়রিয়ায়। বিশ্বে প্রতি বছর ৪ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ অনিরাপদ খাদ্যজনিত রোগে মারা যান, যার মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা শতকার ৪০ ভাগ। অনিরাপদ খাদ্যজনিত রোগে বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশসমূহের ১১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। এছাড়া অনিরাপদ খাদ্যের কারণে মানুষের ২শ প্রকারের রোগ-ব্যাধি হয়। এসব রোগ-ব্যাধি ভৌত বিপত্তি, রাসায়নিক দূষণ, অনুজীব সংক্রমণ ও টক্সিনের কারণে হয়ে থাকে।
রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহেছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল বলেন, আমাদের দেশে ভেজালের একমাত্র কারণ দেখতে পাচ্ছি ভোজ্য তেলে। যত ভেজাল হয় সব ভোজ্য তেলেই হয়। তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে আঞ্চলিক ভাষায় বলেন- ‘অবাজি টিয়া হামা, হনো অসুবিধা নেই। তবে মাইনষরে এককানা ভালা হানা হাবা’।
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. নুরুল আলম নিজামীর সভাপতিত্বে কর্মশালায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী, রেস্টুরেন্ট মালিক, এনজিও কর্মী ও ক্যাব কর্মকর্তাগণ অংশ নেন।
এর আগে এক বর্ণাঢ্য র‌্যালি নগরীর মুসলিম হাই স্কুল থেকে শুরু হয়ে মোটেল সৈকতে এসে শেষ হয়।