আইনরক্ষার হেলমেট ‘জীবনরক্ষার’ নয়!

30

সম্প্রতি ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতার কারণে পেট্রোল পাম্পগুলোতে হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল চালকদের তেল দেয়া বন্ধ করা হয়। এতে করে মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে হেলমেটের ব্যবহার বেড়ে যায়। শুধু মোটরসাইকেল চালক নয়, আরোহীকেও পড়তে হবে হেলমেট। সড়ক নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর এখন প্রায় মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী হেলমেট পরিধান করছেন। আইন মানতে এবং নিজেকে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার তাগিদেই পড়ছেন হেলমেট। কিন্তু অধিকাংশ হেলমেটই জীবনরক্ষাকারী নয়!
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা থেকে জীবন রক্ষাকারী হেলমেটের মান দেখার কথা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্ট্রিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই)। প্রতিষ্ঠানটির বাধ্যতামূলক পণ্যের মান পরীক্ষার তালিকায় আছে মোটরসাইকেল ও স্কুটারের চালক ও আরোহীর হেলমেট। এটি উৎপাদনে ‘বিডিএস মান ১১৩৬ : ১৯৮৬, রিঅ্যাফার্মড ২০০৭’ অনুসরণ করার কথা। কেউ আমদানি করলে তা দেশে এনে বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বিক্রি করার কথা। সকল ক্ষেত্রে হেলমেটে বিএসটিআইয়ের মান চিহ্নসহ বিক্রি করার কথা। কিন্তু বাজার ঘুরে কোনো হেলমেটেই বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের কোনো তদারকিও নেই। এমনকি মান নির্ধারিত হলেও হেলমেট পরীক্ষার কোনো সরঞ্জামও নেই বিএসটিআইয়ের কাছে। আর এ সুযোগে নিম্নমানের হেলমেটে ভরে গেছে বাজার।
এ বিষয়ে বিএসটিআই চট্টগ্রামের পরিচালক সেলিম রেজা বলেন, হেলমেট বিএসটিআইয়ের বাধ্যতামূলক পণ্য। এটির উৎপাদন বা আমদানি করলে বিএসটিআইয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। এটির স্থায়ীত্ব, কতটুকু চাপ সহ্য করার ক্ষমতা এসব দেখার কথা। কিন্তু পরীক্ষার সে সরঞ্জাম বিএসটিআইয়ের নেই।
তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে হেলমেট উৎপাদন হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে হেলমেট আমদানি হচ্ছে। আমদানি নীতিতে বন্দরে বাধ্যতামূলক ৫৫টি পণ্যের মধ্যে হেলমেট না থাকায় আমাদের কাছে মান পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় না। যার কারণে আমরা হেলমেট আমদানি সম্পকৃত তথ্য জানতে পারি না।
প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারান অনেকেই। এর একটি বড় অংশ প্রাণ হারায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় হেলমেট না পড়া। বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ হয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ৮৮ শতাংশের মাথায় কোনো হেলমেট ছিল না।
একইভাবে ২০১৬ সালে ইউনাইটেড ন্যাশনস ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ (ইউএনইসিই) মোটরসাইকেলের হেলমেট সমীক্ষা শীর্ষক একটি গবেষণা করে। এতে বলা হয়, দুর্ঘটনায় অন্যান্য যাত্রীবাহী গাড়ির চেয়ে মোটরসাইকেল চালকের মৃত্যুর আশঙ্কা ২৬ গুণ বেশি। গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়, সঠিক মানের একটি হেলমেট ব্যবহার করলে দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ৪২ শতাংশ বেড়ে যায়।
এদিকে বিশ্ব স্ব্যস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য মতে, আগামী ২০২০ সালে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১ লাখ ৬৩ হাজার থেকে ২ লাখ ১৪ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করলে ৬৯ হাজার থেকে ৯০ হাজার বাইকার বেঁচে যেতে পারে। এতে করে দেশগুলোর সাশ্রয় হবে ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার।
হেলমেটের গুরুত্ব সবাই অনুধাবন করেছে। এই গুরুত্ব অনুধাবনে ইতিমধ্যে হেলমেটের ব্যবহারের সাথে সাথে বাজারেও চাহিদা বেড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যভান্ডার বলছে বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ১৭ কোটি ৭৩ লাখ মার্কিন ডলারের সেফটি হেডগিয়ার বা হেলমেটজাতীয় পণ্য আমদানি হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছর এসব পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৭ কোটি ২২ লাখ ডলার। ফলে আমদানি বেড়েছে ১৪৬ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর এই হেলমেটের ব্যবহার আরো বেড়েছে। বেড়েছে হেলমেট নিয়ে সচেতনতাও। তবে হেলমেটের মান নিয়ে যেমন সচেতন নয় ব্যবহারকারী, তেমনি উদাসিন তদারক সংস্থাও। যদিও হেলমেটের মান রক্ষায় পাশ্ববর্তী দেশ ভারত বেশ তৎপর। ভারতের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস (বিআইএস) হেলমেটের মান নির্ধারণ করে কঠোরভাবে। ভারতীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ও নি¤œমানের হেলমেট উৎপাদন ও বিক্রি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। যদি কেউ করে তাহলে এ অপরাধে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করা যায়।
বাজারে পাওয়া হেলমেট সম্পর্কে কদমতলীর মোটরসাইকেল পার্টস বিক্রেতা তৈয়ব এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্ত¡াধিকারী মোহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, গত ছয় মাস ধরে মোটরসাইকেলের হেলমেট বিক্রি বেড়ে গেছে। চলতি মাসে হেলমেটের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। অল্প কিছু সংখ্যক ক্রেতা ভালোমানের হেলমেট কিনতে চাই। বাকিরা সবাই সস্তায় কেনার প্রতি আগ্রহী। ভালো মানের হেলমেট কিনতে হলে ২ হাজার টাকার উপরে বাজেট করতে হবে। নি¤œমানের হেলমেট ২০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যেও পাওয়া যায়।