অস্ত্র ক্রয়ে নয়, বিশ্বের দরিদ্র মানুষের ক্ষুধা নিরসনে বিলিয়ন ডলার দেওয়া হোক

82

এঙ্গোলা, আফ্রিকার একটি তৈল সমৃদ্ধ দেশ। ঐ দেশের প্রায় ২.৩ মিলিয়ন জনগণ খরার কারণে উপবাসের দ্বারপ্রান্তে। জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী ইয়েমেনেও বর্তমানে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন লোক অনাহারে অর্ধাহারে কালাতিপাত করছে। জাতিসংঘের ভাষ্যমতে এখানে অচিরেই ১৩ লক্ষ লোকের মত মানুষ অনাহার ও অর্ধাহারের সম্মুখীন হতে পারে। পূর্ব ইউক্রেনে ৫ বৎসর আগে রাশিয়া আক্রমণ করেছিল তাতে ১৩০০০ হাজার ইউক্রেনী লোক হত্যার স্বীকার হয়েছিল। হত্যার স্বীকার এই দরিদ্র লোকগুলিকে সে দুর্দিনে বিশ্বের মানবিক সংস্থাগুলি অনাহার থেকে রক্ষা করার জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে সাহায্য সংগ্রহ করে। অন্যদিকে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি, সাউদী আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান এবং অন্যান্য সম্পদশালী দেশগুলি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে তাঁদের নিজেদের দেশের যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য। বর্তমানে এসব দেশ নিজেদের যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য বাৎসরিক প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারের মতো বাজেট করে থাকে। অথচ এঙ্গোলা, সিরিয়া, ইয়েমেন, কঙ্গো এবং ইউক্রেনে এর অর্ধেক টাকা খরচ করলে এবং সব পরাশক্তিগুলি একটু উদারতা এবং আন্তরিকতা দেখালে এই সব দেশে অচিরেই চিরতরে শান্তি কায়েম হবেই। ইয়েমেনের যুদ্ধ বর্তমান সময় পর্যন্ত পাঁচ বৎসরে পদার্পণ করেছে। ইহা বিশ্বের সবচাইতে নির্ধয় যুদ্ধ। কিন্তু তারপরও সি. এন. এন. বা পশ্চিমা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ নিউজ মিডিয়ার হেডলাইন পাচ্ছেনা। ইহার সবচাইতে বড় কারণ হলো ইয়েমেন বিশ্বের কোন উল্লেখযোগ্য তৈল বা গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ নয়। প্রতিদিন শত শত ইয়েমেনী বোমের আঘাতে মরছে হয়তো বা শুধু উপবাসে মরছে এবং পিতা-মাতারা কাধে করে সে রুগ্ন বা আঘাতপ্রাপ্ত সন্তানদেরকে নিয়ে যাচ্ছে কোন ক্লিনিকে ভর্তি করানোর জন্য বা মৃতদেরকে কবরস্থ করার জন্য।
২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত সাউদী আরব ইয়েমেনের উপর ১৯২৭৮ বার বিমান হামলা চালিয়েছে। ইয়েমেনীরা প্রায় শতভাগ মুসলমান। গত বৎসর আগস্ট মাসে সাউদী আরব একটি স্কুল বাসের উপর বিমান হামলা চালিয়ে ৫১ জনকে হত্যা করেছে। যেখানে স্কুলের ছাত্র ছিল ৪২ জন। সাউদী আরবের ছাত্রদের উপর এই নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আমেরিকান হাউস অব কংগ্রেস সাউদী আরবে আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহ করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই প্রস্তাবের কার্যকরিতা আপাতত: সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে মুসলিম দেশগুলির অবস্থা দেখুন, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনার বিষয়ে নজর রাখছে পাকিস্তান, তবে সংঘাত লাগলে পাকিস্তান কারও পক্ষে নিবেননা বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের পর-রাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ-মুহাম্মদ কুরেশী। দেশটির পার্লামেন্টে পর-রাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের একথা জানান। অবশ্য পাকিস্তানের পর-রাষ্ট্রমন্ত্রী তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে নিজের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন। এদিকে আলজাজিরা এবং রয়টার্স এর খবরে প্রকাশ সৌদি আরবের দুটি তেল শোধানাগারে ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। সৌদি আরব মনে করেন এ হামলার পিছসে ইরান সমর্থিত ইয়েমেনী হাউজী বিদ্রোহীরা রয়েছে। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে যে ইরানের কাছ থেকে হুমকির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিমানবাহী রণতরী ও বোমার টাস্কফোর্স পাঠিয়েছে। অবস্থা যেভাবে এগোচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের সাথে ইরানের একটি বড় ধরনের সংঘাত আসন্ন হয়ে উঠেছে।
লিবিয়াও আবার নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। খলিফা হাফটাব, যিনি একজন লিবিয়ান-আমেরিকান মিলিটারি অফিসার, যাঁর নিয়ন্ত্রণে দেশের পূর্বাঞ্চল এতদিন পর্যন্ত ছিল এখন তিনি লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলির দখল নিতে তার সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। এ ঘটনাটি তখনই ঘটে যখন লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলীতে বসে জাতিসংঘে সেক্রেটারি জেনারেল লিবিয়ার জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র এবং তার ভিত্তিতে একটি সাধারণ নির্বাচন দিয়ে লিবিয়ায় কেমন করে শাসনতান্ত্রিক শাসন ফিরিয়ে আনা যায়, এসব নিয়ে ত্রিপলীতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। ঠিক সে সময় জেনারেল হাফটাব লিবিয়াকে একটি নতুন গৃহযুদ্ধে লিপ্ত করে ফেললেন। এখন লিবিয়ায় পূর্ণভাবে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। বর্তমানে লিবিয়ার দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। দু’ পক্ষের যুদ্ধের ফলে মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম এবং যোগযোগের ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধে এই পর্যন্ত ৪১০০০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সব যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলিতে সমস্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। রেল এবং অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থাও সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। বর্তমান বিশ্বে সমস্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে জীবনযাপন করছে। ইয়েমেন, লিবিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ইউক্রেনে বৎসরের পর বৎসর যুদ্ধ চলার ফলে এসব দেশে খাদ্যের এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পন্য সামগ্রীর এমন ভয়াবহ অভাব দেখা দিয়েছে যে মানুষের জীবন ও গরু ছাগলের জীবনের মধ্যে পার্থক্যই চলে গেছে। এইসব যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য হলো এইগুলি এক রকমের প্রক্সি যুদ্ধ, বাইরের শক্তি একটি দেশের দু’পক্ষকে যুদ্ধে নামিয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে এবং মজা দেখছে। ইয়েমেন এবং লিবিয়ার যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলিতে প্রকাশ্যে প্রক্সি যুদ্ধ বলে লেখা হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ্যে লিখছে যে বিশ্বের এসব প্রক্সি যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইরান, ইউএই, ফ্রান্স এব্ং তুরস্ক দায়ী বলে বিশ্ব মিডিয়ায় অহ-রহ লেখা হচ্ছে। তখনও উল্লেখিত দেশগুলি নিজেদের নির্দোষ বলে দোষীদেরকে দেখিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু একথা সত্যি যে তারা তা করতে পারেন না। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি অবশ্যই সত্য।
এবার চলুন বিশ্বের দুটো ব্যাপারে আমরা একটা পরিচ্ছন্ন হিসাব করি। প্রতিদিন কত মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিনযাপন করতে হয় এবং মারা যায়। আর কত মানুষ সন্ত্রাসীদের হাতে বা আইনশৃংখলা রক্ষা কারী বাহিনীর হাতে বা যুদ্ধে মারা যাচ্ছে। কয়েক বৎসর আগে রোমে বিশ্বে খাদ্য ঘাটতির উপর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সম্মেলনের হিসাব মতে মাত্র ৩০ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করলে বিশ্বে একটি লোকও উপবাসে থাকবেনা। অথচ বিশ্বের সমস্ত দেশ মিলে দেশরক্ষার নামে প্রতিবৎসর দুই ট্রিলয়ন ডলারেররও বেশি খরচ করে। যুক্তরাষ্ট্র একাই এই খাতে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে। ১ ট্রিলিয়ন ডলারের মূল্য কত টাকা হতে পারে তা একটু অনুমান করা যাক। বর্তমানে আমেরিকার সর্বমোট জিডিপি ১৭ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলি যদি তথাকথিত দেশরক্ষার খাতে মাত্র শতকারা ২৩ ভাগ খরচ কমিয়ে তা দারিদ্র দূরীকরণে খরচ করে তাহলে অর্থনীতির একটি নগন্য ছাত্র হিসাবে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি বিশ্বে ক্ষুধাপীড়িত এবং জাকাত দেওয়ার মত কোন লোক পাওয়া যাবেনা। কেন তৈল সমৃদ্ধ দেশগুলিতে বিমান আক্রমণের মহড়া চলছে এবং তাতে শত শত নিরীহ লোক মারা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের বক্তব্য হলো বিমান আক্রমণের ফলে যে হারে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে তাতে যে দুর্ভিক্ষ আসবে সে দুর্ভিক্ষ গত ১০০ বৎসরে, কোন সময়ে দেখা যায় নাই। শেষ কথা হলো মিলিটারি বাজেট কমান, বিশ্বে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশ্বের এই মহা-শক্তিশালী বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার রাজনৈতিক শক্তিশালী নেতৃত্বের কি আবির্ভাব ঘটবে?
“নিখিল মানব জাতির লজ্জা সকলের অপমান।
মহামানবের মহা বেদনার আজি মহা উত্থান,
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান। কবি নজরুল ইসলাম।

লেখক : কলামিস্ট