অসাম্প্রদায়িক, পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক মৃণাল কুসুম বড়ুয়ার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

104

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা ও চাকসুর সাহিত্য সম্পাদক মৃণাল কুসুম বড়ুয়া অনেক দিন ধরেই আমার বাসায় আসতে চাচ্ছিলেন। বারবার আমাকে ফোন করে বলতেন আজকালের মধ্যে আসবেন। কিন্তু এ জীবনে সে আসা আর হয়ে উঠলো না। তার আগেই চিত্রগুপ্তের খাতায় তাঁর নাম ওঠে যায়। আমার বাসায় আসব আসব করেও তাঁর আসতে না পারার কারণ হচ্ছে তাঁর বাসা আর আমার বাসার দুস্তর দূরত্ব। তিনি থাকতেন আগ্রাবাদে, আমি চন্দনপুরা। প্রথমবার যখন ফোন করেছিলেন, সম্ভবত বছর দুই হবে, তখন তিনি সুস্থই ছিলেন। অন্তত আমাকে তাই বলেছিলেন। পরে তো তিনি অসুস্থ হয়ে যান। সেই কালব্যাধি শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনটাই হরণ করে নিলো।
মৃণাল বড়ুয়া হাটহাজারীর একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মনোজ কুসুম বড়ুয়া বামপন্থী রাজনীতি করতেন। তিনি কিছুদিন রশিদ বিল্ডিং-খ্যাত আবদুর রশিদ সওদাগরের পৌত্র ও খান বাহাদুর মিঞা খান সওদাগরে দৌহিত্র এবং ভ‚মি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের শ্বশুর আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী সেলিম ও তাঁর ভাই কাইয়ুম চৌধুরীকে পড়িয়েছিলেন। তিনি লজিং থাকতেন ওদের বাড়িতে।
মনোজ বাবুর কারণেই পরিবারটিতে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিলো। মৃণাল প্রগতিশীল হাওয়াতেই বর্ধিত হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনতিকাল পরে ছাত্রলীগ ভেঙে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থী ছাত্রলীগ গঠন, পরপরই নতুন রাজনৈতিক দল জাসদ সৃষ্টি হওয়ার পর সমাজতন্ত্রই জাতীয় রাজনীতির মুখ্য উপাদান হিসেবে দেখা দেয়। মৃণালের মনের জমি এই রাজনীতির জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলো। মৃণাল বড়ুয়া ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এবং জাসদ-পন্থী ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জাসদপন্থী ছাত্রলীগের তখন ভীষণ প্রভাব। মৃণাল এই সংগঠনের একজন বিশিষ্ট নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ৭৮-৭৯-৮০ সালের দিকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ঐ সময় ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন, মৃণাল কুসুম বড়ুয়া তাদেরই অন্যতম ছিলেন। অন্ত-সত্তর ও আশির প্রথমভাগের বিশ্ববিদ্যালয় কাঁপানো সেই ছাত্রলীগ নেতারা হলেন-মরহুম আবুল কাশেম, মোস্তাকিমুল হায়দার খান, মজহারুল হক শাহ চৌধুরী, আবদুল মতিন, খোরশেদ আলম, ড. মনজুর উল আমিন চৌধুরী, স.ম. নজরুল ইসলাম, আমিনুর রসুল, বজলী হোসেন, রায়হানুল ইসলাম চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, মোশাররফ হোসেন, রায়হানুল হক চৌধুরী, মিলন মাহমুদ রোখসান ইসলাম রীতা, কানিজ মাহমুদা পাপড়ি, আবুল কালাম আজাদ, জানে আলম, মুজতবা কামাল।
এই সময় আমি তিন বছর জেল খেটে অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। আমি আলাওল হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। কিন্তু পরীক্ষা দিতে গিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম তখন আমি শাহ আমানত হলে উঠলাম। সেখানে আমি কফিল উদ্দিন চৌধুরীর (পরবর্তীকালে অ্যাডভোকেট এবং চট্টগ্রাম জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর) ৪০৮ নম্বর রুমে থাকতাম। কখনো বা কাশেমের রুমেও থাকতাম। মৃণাল বড়ুয়া আমার সান্নিধ্যে আসেন এবং অল্পদিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন।
শাহ আমানত হলের সম্মুখে ছাত্রনেতা কাশেম একটি চায়ের দোকান দিয়েছিলো। তাঁর ভাইয়েরা সেটা চালাতো। তাঁর দোকানের সামনে সন্ধ্যায় চেয়ার বিছিয়ে আমি রাজনৈতিক ক্লাশ চালু করেছিলাম। কাশেম, মৃণাল কুসুম বড়ুয়া, রায়হানুল হক চৌধুরী, মোহাম্মদ হোসেন, আমিনুর রসুল, জানে আলম, অজয়, নাসিরুল হক নবাব, মুজিবুর রহমান স্বপন, আতিক, আশীষ, জাফর, কফিল, ইমাম শরীফ, আসহাবউদ্দিনরা ছিলো সেই ক্লাশের উৎসাহী শ্রোতা। লাজুক রহমান ও তাঁর ভাগিনা হেলাল, মকবুল ভাই (অধ্যাপক মকবুল আহমদ), রায়হান ভাই (রায়হানুল ইসলাম চৌধুরী), ইমদাদুল হক (বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), সাঈদ ভাই (কৃষি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা), শিল্পী আবদুল মান্নান রানা, নুরুল আলম (বর্তমানে ইয়াংওয়ানের পরিচালক), মাহবুব (বর্তমানে কলেজ শিক্ষক) মাঝেমধ্যে আসতেন। আরো অনেক ছাত্র ক্লাশে ভিড় করতো, তাদের নাম ভুলে গেছি বলে আমি দুঃখিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন মৃণাল বড়ুয়া। তিনি সম্ভবত ভাইবোনদের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন। তাঁর পরবর্তী উদয় কুসুম বড়ুয়া, তিনি প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) করতেন, পরে বিএনপিতে যোগদান করে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন উদয়। ছাত্র ইউনিয়নের ধারায় রাজনীতির চর্চা করলে উদয় অনেক বড় নেতা হতে পারতেন। উদয়ের পরবর্তী তপন; রাজনীতির চেয়ে সংস্কৃতিই তাকে আকৃষ্ট করে বেশি। ফলে তপন আবৃত্তি, নাটক, সঙ্গীত ইত্যাদি নিয়েই মেতে ওঠে। ভালো আবৃত্তি করতো সে, কবিতা লিখতো, উপস্থাপনা করতো, সাংগঠনিক কাজকর্মে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিলো। বিয়ে করেছিলো শিল্পী ইন্দিরা চৌধুরীকে। ইন্দিরা লেখালেখি, গানবাজনা, আবৃত্তি, উপস্থাপনা এমনকি সাংগঠনিক কাজকর্মেও পটু ছিলো। ইন্দিরা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে বহুদিন ধরে শয্যাশায়ী।
মৃণাল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সময়ে যেটা প্রবল হয়ে উঠেছিলো সেই আঞ্চলিকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলো। তিনি শুদ্ধ ও সুস্থ রাজনীতির চর্চা করতেন। বেশ হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল, আড্ডাবাজ এবং পরিহাসপ্রিয় ছিলেন। তাঁর কোন শত্রু ছিলো না, তিনি অজাতশত্রু ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রিয় মুখ ছিলেন তিনি। মৃণাল বড়ুয়া দার পরিগ্রহ করেন নি। আমরাই তাঁর উত্তরাধিকার বহন করবো।
মৃণাল বড়ুয়া এবং তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল রাজনীতির ফুল ফুটানোর জন্য যে মানবজমিন আবাদ করেছিলেন, তার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ফুলে ও ফসলে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। আশির চাকসু করায়ত্ত করা সে কারণেই তো সম্ভব হয়েছিলো।
আমার মনের কোণে ভিড় করে একে একে ভেসে উঠছে সেই সময়ের ছাত্রলীগের গর্বিত নেতা-কর্মীদের মুখচ্ছবি মাহবুব আলম (চেম্বার সভাপতি), জানে আলম, মুজতবা কামাল, মোহাম্মদ হোসেন, মোশাররফ হোসেন, আবদুল মতিন, আশীষ চৌধুরী (অধুনা লন্ডন প্রবাসী), অমিয় শংকর বর্মণ, নাসিরুল হক নবাব, অধ্যাপক মনসুর উল আমিন চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, মুজিবুর রহমান স্বপন, ছালে জহুর মোহাম্মদ বাহাদুর, কামাল উদ্দিন, জাফর আলম (বর্তমানে এমপি), অধ্যক্ষ শাহ আলম, অধ্যক্ষ দীননাথ দে, অধ্যাপক ইলিয়াস চৌধুরী, মুশতাক (ব্যাংকার), মুনিরুল ইসলাম লতিফি, অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম লতিফি, অজয় রতন বড়ুয়া, অ্যাডভোকেট মুজিবর রহমান খান, অ্যাডভোকেট কফিলউদ্দিন চৌধুরী, ব্যাংকার নূর উল আরশাদ চৌধুরী, মুনির, স.ম. জাকারিয়া, শওকত আলী টিপু, মনজরুল হক চৌধুরী বাবুল, হাসিব খান, অধ্যক্ষ আ.ক.ম. গিয়াসউদ্দিন, রফিক, অধ্যাপক আবু তাহের চৌধুরী, নুরুল আফসার, আসহাবউদ্দিন, দেলোয়ার হোসেন, ফরিদুল আলম, ক্যংজরী, মঙকিউ, মেজবাহউদ্দিন টুলু, আবদুল মাবুদ, দেলোয়ার মোহাম্মদ ফারুক, ফরিদুল ইসলাম সাবু, আখতার হোসেন, মেজবাহউদ্দিন, ওবায়েদ, মেজবাহ উদ্দিন মনু, মোবারক হোসেন, সেলিম কলি, মনেয়ার হোসেন মঞ্জু, আবুল কাশেম, হুমায়ুন কবির, লিটন, আজিজ আহমদ, ফখরুদ্দিন, বাকের হোসেন, আবদুর রাজ্জাক, দিবাকর বড়ুয়া, দীপংকর বড়ুয়া, অংথিং মং, মং প্রু মং চৌধুরী (শাহজালাল হল), দিল মোহাম্মদ, সাদেক চৌধুরী, শওকত, আবু সুফিয়ান, গোলাম রহমান।
মৃণাল বড়ুয়ার প্রয়াণে তাঁর বন্ধু, সহকর্মী, সতীর্থ সবাই শোকার্ত বেদনাহত। শোকসন্তপ্ত হৃদয়েই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ তাঁরা চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে একটি স্মরণসভার আয়োজন করেছেন।
আশা করছি মৃণাল কুসুম বড়ুয়ার সহাধ্যায়ী, সহকর্মী, সতীর্থ ও রাজনেতিক সাথীরা আজকের শোকসভায় উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক