অসহিষ্ণু ছাত্রলীগের সংঘাতে অস্থিতিশীল ক্যাম্পাস

157

অসহিষ্ণু ছাত্রলীগের সংঘর্ষে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাস। একের পর এক সংঘর্ষের ফলে বিনষ্ট হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। আর আতঙ্কে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মূলত গ্রুপিং, কমিটি কেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পান থেকে চুন খসলেই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। বহিষ্কার, সমঝোতা, আটক করেও টেনে ধরা যাচ্ছে না অস্থিরতার লাগাম।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে অন্তত দুটি বড় সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষ। এ ঘটনায় অন্তত ১৭ ছাত্রলীগ কর্মী আহত হয়। এসব সংঘর্ষে ককটেল বিস্ফোরণ, ফাঁকাগুলি ছোড়ার ঘটনাও রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, কমিটি ও সাবেক এক নেতার ইন্ধনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা অস্থিরতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে একটি গোযেন্দা সংস্থা।
গত বুধবার রাতে দোকানে বসাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায় শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজনের অনুসারী বগিভিত্তিক সংগঠন বিজয় ও সহসভাপতি জামান নুরের অনুসারী সিএফসি গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীসহ উভয় পক্ষের চারজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এছাড়া আবাসিক হলের বেশ কয়েকটি কক্ষ ভাংচুরের খবর পাওয়া যায়। এসময় প্রতিপক্ষের এক কর্মীর একটি মোটর সাইকেলেও আগুন দেয়া হয়। এর রেশে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে আবারও সংঘর্ষ বাধলে আরো সাতজন আহত হন। আহতদের বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। আহতরা হলো – ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শোইয়াবুর রহমনা কনক, কাকন দে, ইতিহাস বিভাগের মো. ওসমান, বাংলা বিভাগের ইমরান হোসেন, ইংরেজি বিভাগের ফয়সাল ও মো. রহমতুল্লাহ, মৃত্তিকা বিজ্ঞানের মেহেদী হাসান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাফায়াত হোসেন। সংঘর্ষের জন্য দুপক্ষই একে-অপরকে দায়ি করছে। পক্ষ দুটিই নিজেদের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেয়।
এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি গোলাম রসূল নিশানকে অপহরণ করা হয়েছে- এমন খবরে ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ বাধে। গভীর রাতে সাবেক জ্যৈষ্ঠ সহসভাপতি মনছুর আলমের অনুসারী বগিভিত্তিক সংগঠন ‘সিক্সটি নাইন’ ও নিশানের অনুসারী ‘উল্কার’ মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরে উল্কার পক্ষে সাবেক উপ-দফতর সম্পাদক মিজানুর রহমান বিপুলের অনুসারী ‘ভিক্স’, উপ-সাহিত্য সম্পাদক ইমাদ উদ্দিন ফয়সাল পারভেজের অনুসারী ‘একাকার’, উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক রকিবুল হাসান দিনারের অনুসারী ‘আরএক্স’ গ্রুপ যোগ দিলে সংঘর্ষস্থল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ভোর পর্যন্ত চলা এ সংঘর্ষে অন্তত আট ছাত্রলীগ কর্মী আহত হয়ে। পরদিন আবারও সংঘর্ষ বাধলে আরো দুজন আহত হয়। বিবাদমান পক্ষগুলো সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে প্রকল্প উদ্বোধনে আসলেও থেমে ছিল না ছাত্রলীগ। ওই রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল ও সোহরাওয়ার্দী হলে রাতভর অভিযান চালায় প্রশাসন। এতে একটি দেশিয় এলজি পিস্তল, দুই রাউন্ড কার্তুজ, রামদা, লোহার রডসহ দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এসময় সোহরাওয়ার্দী হলের অতিথি কক্ষ থেকে ছাত্রলীগ কর্মীর বান্ধবী বহিরাগত এক তরুণীকে আটক করা হয়। এসব ঘটনায় তিন ছাত্রলীগ কর্মীকে আসামি করে দুটি অস্ত্র মামলাও দায়ের করে পুলিশ।
এর আগে পহেলা ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এএফ রহমান হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে এমদাদুল হক নামে এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে মারধর করেছিল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদের অনুসারী বিজয় গ্রুপের কর্মীরা। মারধরের ঘটনা প্রক্টরকে জানালে ফাহিম হাসান নামে আরেক শিক্ষার্থীকেও মারধর করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত
চার ছাত্রলীগ কর্মীকে ছয় মাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কারও করেছিল কর্তৃপক্ষ।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ব শত্রুতার জেরে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সিক্সটি নাইন ও সিএফসির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল পর্যন্ত থেমে থেমে চলা এ সংঘর্ষে অন্তত পাঁচ ছাত্রলীগকর্মী আহত হয়। পরে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় সমঝোতায় বসে পক্ষগুলো। এ ঘটনায় দুজনকে ছয় মাসের জন্য বহিস্কার করা হয়েছিল। এছাড়া ওই রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলের একটি কক্ষে গাঁজা সেবনের সময় ছয় ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে প্রশাসন।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা পূর্বদেশকে বলেন, ‘কমিটির শীর্ষ পদ নিয়ে আধিপত্যের একটি বিষয় জড়িত। একটি পক্ষ চাচ্ছে- কমিটি হোক, আবার অন্য পক্ষ চাচ্ছে কমিটি না হোক। এই কারণে ক্যাম্পাস সবসময় অস্থির রাখলে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষের লাভ। আর সাবেক এক নেতার ইন্ধনও ক্যাম্পাসে অস্থিরতার অন্যতম কারণ।’
ছাত্রলীগকে মোকাবেলায় ছাত্রলীগের রণপ্রন্তুতি :
প্রায় ১৪ মাস নেতৃত্ব না থাকায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগের এই ইউনিটের নেতাকর্মীরা। ছোট ঘটনা থেকে বড় আকারের সংঘর্ষে জড়াচ্ছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষে ককটেল বিস্ফোরণ, ফাঁকাগুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটছে প্রায়শ। এছাড়া গত কয়েকটি সংঘর্ষে কিছু হলেই ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় পক্ষগুলো। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে দুই আবসিক হলে অভিযান চালিয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘাত লাগতে পারে- এমন খবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ ঝুপড়িতে গিয়ে ছয়টি ধারালো রামদা উদ্ধার করেছিল পুলিশ।
বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন পূর্বদেশকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন কমিটি না থাকা এবং চাকসু নির্বাচনের কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা অসহিষ্ণু হয়ে গেছে। কারণ তাদের কোন কাজ নেই। এর মধ্যে তৃতীয় কোন পক্ষ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পেলেই ঠিক হয়ে যাবে সব।’
একই কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মনছুর আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘সামনে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে একটি পক্ষ ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করছে। যারা ক্যাম্পাসকে আয়ের উৎস মনে করে, তারা চায় না কমিটি হোক।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে অস্ত্রবাজির কোনো স্থান হবে না। আমরা নিয়মিত শাস্তি দিচ্ছি। এরপরও যদি না হয় তবে আরো কঠোর হব। যারা ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করবে তাদের কোন ছাড় নয়।’