অর্থনীতিতে কালো টাকা সৃষ্টি হওয়া সংশ্লিষ্ট সরকারের ব্যর্থতা

67

আমাদের বর্তমান বাজেটে (২০১৯-২০২০) সরকার দেশের বিদ্যমান কালো টাকা সাদা করার জন্য ৫ বৎসরের একটি স্কীম ঘোষণা করেছেন। এই স্কীম নতুন কোন উদ্ভাবন নয়, এর আগেও একই পন্থায় কালো টাকা সাদা করার অক্লান্ত প্রয়াস চালানো হয়েছে। বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে বর্তমানে দেশের নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলিতে কেহ যদি অঘোষিত টাকা (যাকে কালো টাকা নামেও আখ্যায়িত করা হয়) কোন শিল্প গড়ার জন্য বিনিয়োগ করে সেক্ষেত্রে ঐসব টাকার উপর মাত্র ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিলে বিনিয়োগকৃত সে সব টাকার উৎস সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হবেনা। অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত সমস্ত টাকাই বৈধ বলে গণ্য হবে। এখন প্রশ্ন হলো যাঁরা সততার সহিত আয়কর দিচ্ছেন তাঁরা প্রায় শতকরা ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিয়ে তাঁদের টাকা নিয়মিত বৈধ করেছেন। আর যাঁরা অবৈধ টাকা বৈধ করেছেন তাঁরা সরকারী সিদ্ধান্তের পরিপেক্ষিতে মাত্র ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিয়ে তাঁদের টাকা বৈধ করছেন এবং কোন প্রশ্নের সম্মুখীন ও হচ্ছেন না। এখন যদি যাঁরা নিয়মিত উচ্চ হারে আয়কর দিয়ে আসছেন তাঁরা যদি প্রশ্ন করেন, ইহা কি সততার পুরস্কার? কালো টাকার মালিকেরা মাত্র ১০ শতাংশ আয়কর দিযে মুহুর্তে কোটি কোটি টাকা বৈধ করে নেওয়ার সুযোগ পেল আর তাঁরাও সুযোগ সুবিধাগুলি সমভাবে ভোগ করবে। এই ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা যে উৎসাহিত হচ্ছেনা তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? আসলে সরকারেরও অসহায়তা করুণভাবে ফুটে উঠেছে। আজকের ডিজিটাল বিশ্ব একটা আধুনিক গ্রামের রূপ নিয়েছে। শত চেষ্টার পরও বিশ্বের কোন দেশই নিজেদের পুঁজি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম হচ্ছেনা। এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবৈধভাবে পুঁজি স্থানান্তর এমন সহজ হয়েছে যে বর্তমান বিশ্বের কোন আধুনিকতম সরকারের পক্ষেও পুঁজি পাচার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা কোন ভাবেই সম্ভব হচ্ছেনা, বর্তমানে বিশ্বের আধুনিক পুঁজি পাঁচারকারী চক্রের কাছে যে কোন সরকার জিম্মি হয়ে পড়েছে। আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের এই ব্যাপারে অসহায় অবস্থা শুনলে গা শিহরিত হয়ে উঠে।
কিন্তু সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে পুঁজি বিনিয়োগের স্বার্থে এই সব অনৈতিক সুবিধা কালো টাকার মালিকদের দেওয়া সত্তে¡ও অতীতে খুব একটা সফল হয় নই। ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এই সুযোগ দেওয়ার পরও, এই সময়ে মাত্র ১৮,৩৭২ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছিল এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১৫২৮.৭৮ কোটি টাকা ট্যাক্স পেয়েছিল। গত কেয়ার টেকার সরকারের আমলে ৯৬৮২ কোটি কালো টাকা একই পদ্ধতিতে সাদা করা হয়েছিল। এর আগেও বি.এন.পি পরিচালিত সরকার এরকম কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল কিন্তু তারাও কোন উল্লেযোগ্য সফলতা দেখাতে পারেন নাই। এবারও এব্যাপারে সফলতার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা যায় বাংলাদেশের কালো টাকার পরিমাণ এত বেশি যে, এখানে আর একটি সমান্তরাল অর্থনীতি গোপনে সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সমান্তরাল অর্থনীতির উপর একটি হিসাব দেওয়া হয়েছিল, সে হিসাবে দেখা যায় তখন বাংলাদেশের সমান্তরাল কালো অর্থনীতিতে বিনিয়োগকৃত পুঁজির পরিমাণ ছিল ৪৫৩২.৭১ বিলিয়ন ডলার। গত চার বৎসরে নিশ্চয় এর পরিমাণ আরও অনেক বেড়েছে। ২০১২ সালে আমাদের অর্থমন্ত্রণালয় কালো বাজারে বিনিয়োগকৃত পুঁজির পরিমাণ করতে গিয়ে রির্পোট দিয়েছিল যে এ পুঁজির পরিমাণ আমাদের জি.ডি.পির ৪৫% শতাংশের উপরে হবে। উপরে দেওয়া হিসাবে ভুলভ্রান্তি যাই তাক না কেন একথা সত্য যে কালো টাকার একটি বিরাট অংশ বাজারে পুঁজি হিসাবে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়াও ইতিমধ্যে কালো টাকার একটা বিরাট অংশ বিদেশে সরানো হয়েছে। সত্য বলতে কি পুঁজির-পাঁচার বন্ধ করা মহা-শক্তিশালী সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয়। কেবল মানুষের মধ্যে গভীর দেশাত্মবোধই এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। তারপরও নাই মামার চাইতে কানা মামা ভালো মনে করে সরকার কালো টাকা সাদা করার নানা ফন্দি ফিকির করে যাচ্ছেন। আসলে বর্তমান বিশ্বে কালো টাকা সাদা করে নিজ দেশে বিনিয়োগ করানো একটি কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাইরের থেকে পুঁজি আকৃষ্ট করে স্ব স্ব দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করছে। এমনকি সাউদী আরব পর্যন্ত সম্প্রতি বিদেশি পুঁজি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। আমাদের দেশের ব্যক্তিগত আয়ের উপর আয়করের হিসাবটা পর্যালোচনা করলে অর্থনীতিতে বালো টাকার পরিমাণ কত হবে তা যে কোন অর্থনীতির ছাত্র বলে দিতে পারবে। ২০১১-২০১২ সালে আমাদের এন.বি.আর. এর দেওয়া হিসাব মতে ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) লোক ব্যক্তিগত আয়ের উপর আয়কর দিয়েছিলেন, কিন্তু সে সময় আমাদের দেশে সরকারী হিসাব মতে মাল্টি মিলনিয়রের সংখ্যা ছিল ২৩,২১২জন এরপরও মাল্টি মিলনিয়ারের সংখ্যা প্রত্যেক বৎসর বেড়েছে, কিন্তু সে ভাবে কর আদায় করতে দেখা যায় নাই্ এখানেই আমাদের আসল দুর্বলতা নিহিত রয়েছৈ। কর ব্যবস্থার আওতায় কর ,দাতাদের আনার ব্যাপারে প্রথম বাধা হলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্য এবং দ্বিতীয় হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। এই ব্যাপারে সরকারের সামনে কঠোর হওয়ার কোন বিকল্প নেই। কালো টাকার সূতিকাগার হলো রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি এবং সরকারের অন্যান্য স্তরের দুর্নীতি। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সব সময় কঠোর অবস্থানে না থাকলে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। দুঃখের বিষয় হলো আগে বেশিরভাগ আমলা খুব উচ্চমানের শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তাঁদের মানবিক মূল্যবোধ ছিল উচ্চমানের। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বর্তমান সময়ে বিশ্বের প্রায় দেশের আমলাদের মধ্যে সে মেধা, প্রজ্ঞা এবং সততা দেখা যায় না। ফলে সরকারের বিভিন্ন শাখায় শুধু দুর্নীতি বেড়েছে তা নয়, বহুক্ষেত্রে দুর্নীতির আধুনিকায়নও হয়েছে।
অর্থনীতিতে কালো টাকা সৃষ্টির প্রধান উৎস হলো রাজনৈতিক এবং সরকারের সর্বস্তরের আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি। সে জন্য কালো টাকা নিয়ন্ত্রণ করা একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। সত্যিকারের অর্থে দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে সরকারের নিয়ন্ত্রন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন “দুর্নীতি দমন সংস্থার” প্রয়োজন। সরকারী নিয়ন্ত্রণ মুক্ত বলে অভিনয় করবে অথচ সরকারের সমস্ত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, সে রকম দুর্নীতি দমন সংস্থা দিয়ে কাজের কাজ কিছুই হবে না। ‘অর্থনীতিতে কালো টাকা সৃষ্টি হওয়াই সংশ্লিষ্ট সরকারের ব্যর্থতা’ একথা বিশ্বের কোন সরকার অস্বীকার করার আইনতঃ অধিকার রাখে না।
কাজেই কালো টাকা সাদা করার ফন্দি ফিকির বের না করে, কালো টাকা সৃষ্টি করার সুযোগ চিরতরে বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ এবং স্বাধীনতা দিতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকেরা যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি প্রণয়নে সব সময় হস্তক্ষেপ করে সে অবস্থায় দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অবশ্যই রুগ্ন হয়ে পড়বে। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে ব্যাংকের পরিচালকেরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মালিক মনে করে। প্রত্যেকটা ব্যাংকের ৯০ শতাংশেরও বেশি টাকা সাধরণ গ্রাহকদের। ১০ শতাংশেরও কম পুঁজি বিনিয়োগ করে সমস্ত ব্যাংকের মালিক মনে করা আহম্মকের স্বর্গে বাস করার মত। আবার প্রায় ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে ব্যাংক থেকে তথাকথিত মালিকেরা ঋণ হিসাবে তাঁদের বিনিয়োগকৃত অর্থের প্রায় কয়েক শতগুণ বেশী নিয়েও যান।
আমরা বার বার সরকারকে অনুরোধ করছি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। এই ব্যাপারে একটা শক্তিশালী কমিশন নিয়োগ করে করণীয় সাব্যস্ত করা অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
লেখক : কলামিস্ট