‘অযোগ্য’ সাব-কন্ট্রাক্টরে দুর্গতি

62

চকবাজার কাতালগঞ্জ মোড়। গত শনিবার সড়কটির বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে ওয়াসার পাইপলাইনের কাজ করতে গিয়ে পুরোনো একটি পাইপে ফুটো করে ফেলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। সরবরাহ লাইন ফুটো হওয়াতে প্রচুর পানি বেরুতে থাকে। তলিয়ে যায় পুরো এলাকা। এভাবে চলার দুইদিন পর ফুটোটি মেরামত করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একই সময়ে নবাব ওয়ালি খাঁ মসজিদের সামনে এবং ফকিরহাটেও পাইপলাইন ফুটো হওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ওয়াসার লাইনের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনি প্রচুর পানির অপচয় হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে এমন ঘটনা ঘটলেও ওয়াসা কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করেনি।
পাইপলাইন বসানোর কাজে নগরীর সড়কগুলোতে ওয়াসার নির্বিচার খোঁড়াখুুঁড়ি এবং মাঝখানে পাইপ ফুটো হয়ে পুরো এলাকা পানিতে সয়লাব হওয়ায় প্রতিনিয়তই দুর্ভোগে পড়ছেন নগরবাসী। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কাগজে-কলমে না থাকলেও ‘অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ’ কিছু সাব কন্ট্রাক্টর দিয়ে পাইপলাইনের কাজ করানো হচ্ছে। আর এসব সাব-কক্ট্রাক্টররা অদক্ষ শ্রমিক দিয়েই কাজ করান। এ কারণে বারবার ফুটো হচ্ছে পাইপলাইন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন পাইপলাইন স্থাপনের জন্য শহরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। বর্তমানে দুইটি প্রকল্পের অধীনে চলছে পাইপলাইন স্থাপনের কাজ। নতুন লাইনের কাজ করতে গিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়মিতই পুরাতন লাইনে সমস্যার সৃষ্টি করছে। পুরাতন লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়া, ফুটো বা লিকেজ হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এতে পানি সরবরাহ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি অপচয় হচ্ছে প্রচুর পানি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে এ বাবদ ক্ষতিপূরণ নেয়ার কথা থাকলেও সে নিয়ম মানা হচ্ছে না। এতে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে ওয়াসা।
ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ঠিকাদার কাজ করতে গিয়ে বর্তমান লাইনের কোনো ক্ষতি করলে সেটা তাদের মাধ্যমে সংস্কার করিয়ে নেয়া হচ্ছে। না করলে জরিমানা করা হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত তারা নিজেরাই সংস্কার করে দিয়েছে বা তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইদানিং বড় পাইপলাইন বসানোর কাজ করতে গিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরাতন পাইপলাইন। ক্ষতিগ্রস্ত লাইন সংস্কার করা না হলে তাদের চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়। ফুটো হলে অপচয় হওয়া পানির খরচ দেয়ার জন্যও চিঠি দেওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে যাবতীয় পাওনা আদায় করা হবে।
নগরীতে পানি সরবরাহ বৃদ্ধি ও বিদ্যমান সরবরাহ লাইন আধুনিকায়নের কাজ করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। ইতিমধ্যে পুরো শহরে পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় সড়ক খোঁড়া হচ্ছে পাইপলাইনের কাজের জন্য। নতুন পাইপলাইনের কাজ করতে গিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুরাতন লাইনের ক্ষতি করছে। খোঁড়াখুঁড়িতে কখনো কাটা পড়ছে লাইন আবার কখনো ফেটে যাচ্ছে। এছাড়াও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বর্তমান পাইপলাইন। আবার পাইপলাইন ফেটে গেলে প্রচুর পানি বেরিয়ে পড়ছে। যার কারণে ওয়াসার পানির অপচয় হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদার থেকে এই ক্ষতিপূরণ নেওয়ার কথা ওয়াসার। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি ওয়াসা।
এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহর দপ্তরে গেলেও তিনি ঢাকায় থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নিয়মিত লিকেজ ধরা পড়লেও প্রতি সপ্তাহে বা মাসে কি পরিমাণ লিকেজ হচ্ছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই ওয়াসার কাছে। তবে ওয়াসার দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ছোট থেকে বড় লিকেজ নিয়মিত লেগেই আছে। অযোগ্য সাব কন্ট্রাক্টরদের মাধ্যমে কাজ করানোর কারণেই নিয়মিত এমন লিকেজ হচ্ছে। এসব লিকেজের জন্য ওয়াসার ক্ষতিপূরণ দাবি করার কথা থাকলেও তা না করে ঠিকাদারের মাধ্যমে সংস্কার করিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে লিকেজে প্রচুর পানির অপচয় হলেও ঠিকাদার থেকে মূল্য নেওয়া হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, পুরাতন পাইপলাইনগুলো সিমেন্টের ডালাইয়ের। যার কারণে নতুন পাইপলাইন বসানোর সময় ফেটে যাচ্ছে বা ফুটো হয়ে যাচ্ছে। ঠিকাদারের মাধ্যমে আমরা আবার সেটা সংস্কার করে নিচ্ছি। শুধু ওয়াসার নয়, টিএন্ডটি, পিডিবি বা অন্য কোনো সংস্থার লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটাও সংস্কার করে নেয়া হয়।
তিনি বলেন, পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঠিকাদার থেকে ক্ষতিপূরণের অপশন আছে। ক্ষতিপূরণ আদায় না করে আমরা তাদের মাধ্যমে সংস্কার করিয়ে নিই। সংস্কার কাজ করতে না চাইলে তাদের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। তবে ওয়াসার চলমান প্রকল্পের কাজে কোনো সব কন্ট্রাক্টর নেই।
জানা গেছে, লাইন ফুটো করা ও পানির অপচয়ের জন্য ঠিকাদারদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় না করার বিষয়টি নিয়ে বোর্ড সভায়ও আলোচনা হয়েছে। কাজ করার সময় লিকেজের কারণে পানি অপচয় হলে এর মূল্য ঠিকাদারের কাছ থেকে আদায় করার কথাও আলোচনা হয় বোর্ড সভায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বোর্ড সদস্য বলেন, প্রকল্পের কাজ যোগ্যতাসম্পন্ন ঠিকাদারের মাধ্যমে করার কথা। এখন কাজগুলো দুই-তিন হাত বদল হয়ে সাব কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে হচ্ছে। অযোগ্য এসব সাব কন্ট্রাক্টর কাজ করতে গিয়ে নিয়মিত লাইনের ক্ষতি করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন লিকেজ হচ্ছে, মূল সার্ভিস লাইন বিকলাঙ্গ হচ্ছে। প্রচুর পানির অপচয় হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী সার্ভিস লাইনের ক্ষতি ও পানির অপচয়ের টাকা ঠিকাদার থেকে আদায় করার কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওয়াসা ঠিকাদারদের কাছ থেকে এক পয়সাও ক্ষতিপূরণ আদায় করেনি। বোর্ডে বিষয়টি একাধিকাবার আলোচনা হলেও এমডির রহস্যজনক ভূমিকার কারণে ক্ষতিপূরণ আদায় সম্ভব হচ্ছে না।