অমুসলিম মনীষীদের দৃষ্টিতে মহানবী (দ.)

267

আরবের নবী করুণার দাবি রহমতে সাগর নিয়ে সৃষ্টিজগতে শুভ আগমন করেন। তাঁর ক্ষমা ও মহানুভবতায় অনুপ্রাণিত হয়ে লক্ষ কোটি মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। তিনি সমগ্র সৃষ্টির জন্য আশীর্বাদ হয়ে প্রেরিত অভিশাপ নয়। চরম শত্রæকেও তিনি জীবনে অভিশাপ দেননি।
উহুদের যুদ্ধে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শহীদ করতে কাফির গোষ্ঠি তাঁর শরীর ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত করে। দান দান মোবারক শহীদ কবে। সাহাবীরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাফিরদের অভিশাপ করতে বললে, করুণার নবী বললেন, ‘কখনো নয়, আমি কারো প্রতি অভিশাপ দিতে প্রেরিত হইনি।’ অভিশাপের পরিবর্তে তিনি দোয়া দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার সম্প্রদায়কে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন, তাদেরকে ক্ষমা করে দিন, তারা আমাকে বুঝতে পারেনি, চিনতে পারেনি।’ দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শনের ব্যাপারে এর চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে।
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত আবু সুফিয়ান (রা.) ছিলেন ইসলামের বড় শত্রæ। তার ষড়যন্ত্র ও আক্রমণে শত শত মুসলমান শহীদ হয়। মক্কা বিজয়ের পর তিনি নবীজীর দরবারে হাজির হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। নবী কন্ঠে তখন উচ্চারিত হলো আজ থেকে আবু সুফিয়ানের বাড়ির চতুরপার্শ্বের সীমানা মধ্যস্থ এলাকা হবে নিরাপদ এলাকা।
মক্কা বিজয়ের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা নগরীতে বীরের মতো প্রবেশ করেন। কাফিরগণ ভীত-সন্ত্রস্ত। সকলের পুরোনো দিনের কথা স্মরণ হচ্ছিল। কারণ তারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীরে পাথর নিক্ষেপ করেছিল। উটের নাড়ি-ভুরি গায়ে চাপিয়ে দিয়েছিলো। নবীজীর গলা চেপে ধরেছিল। নির্যাতন করে মক্কা ও বাইতুল্লাহ শরীফ থেকে বের করে দিয়েছিল, আজ তিনিই এ মক্কার রাষ্ট্র প্রধান। অত্যাচারী কোরাইশরা ভয়ে কাঁপছে। কত বড় শাস্তি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে জানা নেই। কিন্তু বিশ্ব জগতের রহমত, মহানুভবতার শ্রেষ্ঠতম আদর্শ বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ যা হওয়ার হয়ে গেছে, আজ তোমাদের সকলের প্রতি আমরা সাধারণ ক্ষমা। তোমাদের কারো প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই’।
বিশ্ব ইতিহাসের পাতা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ক্ষমতার এমন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয় আরেকটি পাওয়া যাবে না। শুধু মুসলমান মনীষীগণ নয় অমুসলিম মনীষীরা পর্যন্ত হত্যা সন্ত্রাস, হিংসা- জিঘাংসা, প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত বিশ্বে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ ধরনের মহান আদর্শগুলো অনুসরণ করতে আহŸান জানিয়েছেন।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু মুসলমানদের জন্য প্রেরিত হয়নি, তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টির জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর আদর্শ সর্বজনীন। আল্লাহ পাক স্বয়ং নিজেই ঘোষণা করেছেন, ওয়ামা আবসাল্নাকা ইল্লা কাফকাতালিন্নাস বাশিরান ওয়া নাজিরান্ ওয়ালাকিন আক্সারান্নমেলা এয়ালামুন’। অর্থাৎ হে রাসুল! আমি আপনাকে সৃষ্টি করেছি সার্বজনীন পয়গম্ব করে মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে।
বিশ্ব বিখ্যাত খ্রিস্টান গবেষক মাইকেল এইচ হার্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একশত জন মহামানব সম্পর্কে আলোচনা করে ‘ঞযব ঐঁহফৎবফ ’নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে একশ’জন ব্যক্তিত্বের তালিকায় বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বপ্রথম এবং সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সকল দিক দিয়ে সর্বোত্তম এবং সর্বাধিক প্রভাবশালী মনে করেছেন।
এইচ হার্ট বলেছেন, ‘খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে যীশুর অবদানের তুলনায় ইসলাম ধর্ম প্রচারে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শক্তিশালী আদর্শ স্থাপন ও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছেন, তাতে আমার কাছে তাঁকেই বেশী মর্যাদাবান বলে মনে হয়েছে। হযরতের আদর্শ জীবন পর্যালোচনা করে লেখক তাঁর রচিত এই গ্রন্থে আরো বলেছেন, কোন কোন পাঠক হয়তো বিষ্মিত হতে পারেন কিন্তু তিনিই পৃথিবীর বুকে একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় এবং পার্থিব উভয় জীবনে পরিপূর্ণভাবে সফলতা অর্জন করেছেন।
ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বলেছেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সে যুগের জীবন ধারায় ইসলাম যে স্থান লাভ করেছিল, তা তরবারির জোরে নয়, নবীর অশেষ সরলতা, যতœশীলতা, তাঁর সহচর ও অনুবর্তী জনগণের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ, তাঁর সাহসিকতা, নির্ভীকতা, স্রষ্টার ও তাঁর নিয়োজিত প্রচার কার্যের প্রতি একান্ত বিশ্বাসের কারণে। এই সকল গুণই সর্ববিষয়ে তাঁদের সাফল্য দান করেছিল এবং সকল বাধাবিঘœ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল।
পাশ্চত্য-ঐতিহাসিক ঝরৎ রিষষরধস গঁরৎ বলেছেন, অদৃশ্য গুণরাজি তৎকালে মক্কাবাসীদের মধ্যে অতি বিরল ছিল। এই সরল প্রকৃতি যুবকের সুন্দর চরিত্র ও সম্মান আচরণ তাঁর দেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল এবং সর্বসম্মতিক্রমে ‘আল আমীন’ আখ্যা লাভ করেছিলেন।
ইড়ংড়িৎঃয ঝসরঃয বলেছেন, হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে সিজারের ন্যায় শাসনতন্ত্রের শীর্ষস্থানে এবং পোপের ন্যায় ধর্ম মন্দিরের উচ্চাসনে সমাসীন ছিলেন।
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজকে যেভাবে সংস্কারের মাধ্যমে ত্রæতিমুক্ত করেছিলেন এবং অমুসলিমদের প্রতি উদারতা দেখিয়েছিলেন, তা অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক সম্ভব হয়নি। তিনি মদিনার সকল ধর্মের জন্য যে সনদ (ঈযধৎঃবৎ) প্রণোয়ণ করেছিলেন তা জগতের ইতহাসে সংখ্যালঘুদের প্রতি সহনশীলতা ও সদয় দৃষ্টির এক অপূর্ব আদর্শ। তাই (খধহব চড়ড়ষ) বলেছেন, ‘ইসলাম পূর্ববর্তী নবীদের ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করে অন্যান্য ধর্মের চেয়ে অধিক সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।
বদরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মক্কাবাসীগণ তাদের নিহত সেনাদের মৃতদেহ করবস্থ না করেই চলে গিয়েছিল। দয়ার্দ্র নবী নিজেই ঐ সকল লাশ কবর দিয়েছিলেন। উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাই স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছেন, হযরত মোহাম্মদ এর বাণী ও আদর্শ নব জাগরিত আরব হৃদয়ে এক নতুন ভাবের প্রেরণা এনে দিয়েছিল।
মানব ইতিহাসে বহু খ্যাতিমান মনীষী ও মহান ব্যক্তিত্বের পরিচয় জানা যায়, কিন্তু তাঁদের কারোই জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত সমগ্র জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়সহ পূর্ণাঙ্গ জীবনের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় ান। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর শুভ আগমন হতে ইন্তেকাল পর্যন্ত জীবনের সমস্ত খুুঁটিনাটি বিষয়সহ পূর্ণাঙ্গ জীবন উজ্জ্বল দর্পণের ন্যায় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাঁর সমগ্র জীবনে বিচ্যুতি বা কলঙ্গের সামান্য আচড়ও পরিলক্ষিত হয় না। লেনপোল ঝঃঁফরবং রহ গড়ংয়ঁব গ্রন্থে বলেন, ‘মোহাম্মদ (দ.)ই ছিলেন পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর জন্ম এবং অনুভূতি জাগ্রত হওয়া থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত ছন্দপতনহীনভাবে একটানা পূত পবিত্র-জীবনযাপন করে গেছেন। কখনো তাঁর সত্তার পরিচয় বিস্মৃতি ঘটেনি। যে জায়গায় তিনি নিয়ে এসেছিলেন এ পয়গামের প্রচার তা প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর জীবন। আপন ব্যক্তিত্বের মর্যাদা এবং নিজ জাতির শাসক হওয়া সত্তে¡ও তাঁর কাছে যে বিনয় নম্রতা পাওয়া যায় এমনটি আর কোন শাসক বা পয়গম্বরের ভাগ্যে জুটেনি।
ঊহপুপষড়ঢ়বধফরধ ইৎরঃধহহরপধ তে বলা হয়েছে ঙভ ধষষ ঃযব ৎবষরমরড়ঁং চবৎংড়হধষরঃরবং ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ গড়যধসসধফ ধিং ঃযব সড়ংঃ ঝঁপপবংংভঁষ অর্থাৎ বিশ্বের সকল ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে মোহাম্মদ (দ.) সর্বাপেক্ষা সফল ছিলেন। আর পশ্চাত্য মনীষী জন ডিভনের মতে ‘সমস্ত ধর্ম প্রবর্তক ও বিজয়ীদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যার জীবন চরিত্র মোহাম্মদ (দ.) এর জীবন চরিত্র থেকে সুবিস্তৃত ও নির্ভরযোগ্য।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মগ্ন হয়ে প্রখ্যাত বৃটিশ লেখক চিন্তাবিদ টমাস কার্লাইল বলেছেন, ‘আরব জাতির পক্ষে এ ছিলো আঁধার থেকে আলোর জন্ম; তারা এতে পেলো মহৎ জীবন। এক গরীব রাখালের জাতি পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে তার মরুভূমিতে সকলের অজ্ঞাতসারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, এক বীর নবীকে উপর থেকে পাঠানো হলো তাদের কাছে এমন বাণীসহ, যা তারা বিশ্বাস করতে পারে। দৃশ্যত যা অজ্ঞাত অখ্যাত তা হচ্ছে জগদ্বিখ্যাত, ক্ষুদ্র হচ্ছে বিরাটতম। তারপর এক শতাব্দীর মধ্যে আরব প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে এদিকে গ্রানাডায় আর ওদিকে দিল্লীতে …বীর্য ঐশ্বর্য আর প্রতিভার আলোকে আলোকিত হয়ে আরব বহু যুগ ধরে পৃথিবীর এক বড় অংশের উপর আলো দিচ্ছে। একটি মৃত জাতির জীবন দান, একি শত সহস্র মৃত ব্যক্তির জীবন দানের চেয়ে অলৌকিক নয় ?
জজ বার্ণার্ড শ’ এবঃঃরহম গধৎৎরবফ গ্রন্থে লিখেছেন, আমি মোহাম্মদ (দ.)কে অধ্যয়ন করেছি। আমি বিশ্বাস করি মোহাম্মদ (দ.) এর মত কোন ব্যক্তি যতি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন তাহলে তিনি এমন উপায়ে এর সমস্যাগুলো সমাধানে সফল হতেন, যা পৃথিবীতে বয়ে আনত বহু আকাক্সিক্ষত সুখ ও শান্তি’।
লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক