অমর একুশে ফেব্রুয়ারি

140

যে শিশু আর কোনোদিন/ তার পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না/ যে গৃহবধূ আর কোনোদিন/ তার স্বামীর প্রতীক্ষায় আঁচলে প্রদীপ ঢেকে দুয়ারে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না/ যে জননী খোকা এসেছে বলে উদ্দাম আনন্দে/ সন্তানকে আর জড়িয়ে ধরতে পারবে না/ যে তরুণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে/ বার বার প্রিয়তমার ছবি চোখে আনতে চেষ্টা করেছিল/ তাদের সবার নামে আমি শাস্তি দাবি করতে এসেছি/ কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি…
উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তৎকালীন আর্য সভ্যতায় বসবাস করেও আর্য ভাষার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। তিনি অহিংস-নীতি অনুসরণ করে স্থানীয় মুখের ভাষা ‘পালি’ ভাষায় ‘ত্রিপিটক’ রচনা
করে বিদ্রোহের জবাব দেন। ভাষিক-বিদ্রোহের এ ধারা বাঙালির বাংলা ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে বলেও ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তৎকালীন পাকিস্তানে সংস্কৃতিগত মিল না থাকায় হাজার মাইলেরও বেশি ব্যবধানের একই রাষ্ট্রভুক্ত দু’টি দেশের মানুষের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। দু’টি পৃথক জাতি এবং পৃথক ভাষা। দুই বাংলার মধ্যে পূর্ববঙ্গে বসবাসকারীরা স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। এটিই বাংলা ভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠের এই বাংলা ভাষা, যার রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। প্রায় দুইশ’ বছর শাসনের পর ইংরেজরা উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ধর্ম বা দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা শুরুতেই পূর্ববঙ্গে বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর ভাষিক-নিপীড়ন শুরু করে। এই নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষীদের বেঁচে থাকার প্রশ্নও জড়িত ছিল। পরবর্তীকালে বাংলাভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যে মৌলিক ভিত্তির ওপর বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার পুরোটা জুড়েই রয়েছে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা। মাতৃভাষা আর রাষ্ট্রভাষার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। অঞ্চলভেদে মাতৃভাষার পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার কখনও পরিবর্তন হয় না। ভাষা হিসাবে বিশ্বময় ইংরেজির গুরুত্ব থাকলেও নিজের দেশে বাংলা ভাষাকে বাঙালি জাতি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কতটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছে তা ভাববার সময় এসেছে।
বিশ্বে বাঙালি জাতি হিসাবে পরিচয়ের সার-সত্য অনিবার্যভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারিতে নিহিত রয়েছে। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন বিসর্জন দেয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। বলা যায়, এর একমাত্র দাবিদার বাঙালি। যে কারণে বাংলা ভাষা আজ সর্বজনীন ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৯৯ সাল থেকে ইউনেস্কোর কল্যাণে বিশ্বব্যাপী একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র বাঙালির জন্মের অহঙ্কার। বাংলাভাষা বাঙালির বেঁচে থাকার অলঙ্কার। জাতির অস্তিত্বের ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় রচিত কবিতা ও গানে আত্মমুক্তির যে ঋদ্ধ উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিল, বুদ্ধিবৃত্তিক যে চেতনা প্রাণে প্রাণে সঞ্চারিত হয়েছিল সেই অবিনাশী চেতনা আজও প্রবাহমান। বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের নাম যেমন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তেমনি বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকেও জাগ্রত রাখতে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা, এই চেতনার গহীনেই বাঙালির মুক্তির বীজ রোপা আছে।