অভীক ওসমানের কবিতার বিষাদের নীল যমুনা

95

কবিতা পড়তে গেলে খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়, স্মৃতির টানটান সুতোয় টান পড়ে। মন খারাপ হয়ে যায় পাঠকের। বেশ কয়েকটি কবিতা আছে যার রেশ অনেক্ষণ পরেও ফুরিয়ে যায় না। তবে আমাদের স্বীকার করতেই হবে সব কবিতা গুলোই বিষয়ভিত্তিক অর্থাৎ বিষাদের নয়। বিষাদের কবিতাগুলোর আগেপরে নানা স্বাদের অভিজ্ঞতার, তিক্ততার কবিতাও পাই আমরা। ‘সংস্কৃতি’, ‘তাৎক্ষণিক’, ‘ক্রীড়া’, ‘বিজ্ঞাপন…’, ‘বিরাট বিটপীর অহংকার’, ইত্যাদি কবিতাগুলো বিষাদের মেজাজের সাথে একেবারেই মেলে না। সেসব বিবেচনার আগে দ্রুতগতিতে বিচার করা যাক অন্যান্য কবিতা শরীরের। বিষাদের জার্নাল বইয়ের কবিতাগুলোকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
বিষাদপ্রধান, স্মৃতিকাতরতা এবং আক্রমণাত্মক বা প্রতিরোধ বিষয়ক। এতো গেল সাদামাটা বিষয়ভিত্তিক বক্তব্যের কথা। কিন্তু কাব্যিক মনের ব্যাখ্যা? অবশ্যই সম্ভব। ভাব, বক্তব্য বিষয়, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি যে মানদন্ডেই অভীক ওসমানের কবিতাকে বিচার করা হোক না কেন কবিতাগুলো যে প্রাথমিক পর্যায়ে নেই, বোধ করি সবাই এ কথা মানবেন। অনবরত কবিতা হয়ে উঠবার একটি যন্ত্রণা অভীকের রচনায় লক্ষ্য করি। প্রেমবোধ, স্বপ্ন কাতরতা, স্মৃতি রোরুদ্যমান বোবা কান্নার চেয়ে বিষাদটাকেই প্রাধান্য দেন অভীক। যেমন ‘মনসার অভিশাপে কাঁদে কি কোনো মরাল নাগরাজ। অথবা লখিনের কংকাল ভেলায় বেহুলা।’
ভাটিয়ালি সিরিজের কয়েকটি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে। এসবের মধ্যেও বিষাদ বোধ-
১. আমার ভেতর কাঁদে বিনিদ্র ভোরের যীশু
আমার ভেতর কাঁদে স্মৃতি
২. দুঃখের এতো রূপ আছে, কষ্টের এতো রূপ
আমি কোনোদিন দেখিনি
৩. তুমি আমার ভাটিজলের দুঃখ নদী
কবিতা আর অভিমান সম্ভবত সমান বয়সী। যেকোনো কবিই অভিমান গোপন করেননি। করতে পারেননি। কবি অভিমানের ছবি আঁকেন এভাবে
১. কেউ আমার নয়, ঢেউ হয়ে ফিরে যাক
আমি কারো প্রেমিক নই। তোমারও নয়।
২. তুমি কি দেখো না, দেখেও কি ভান কর?
৩. এ সময় ঘুড়ি ওড়াবার সময়, ফিরে যাও নারী ফিরে যাও
‘বিষাদের জার্নালে’ বিষাদ ছড়িয়ে থাকলেও মাত্র সাতটি কবিতাই কেন বিষাদের তকমা পরলো? কবি কি মনে করেন ‘চোখের অসুখ’ ‘প্রিয়তম ঘাতক’ ইত্যাদি কবিতায় বিষাদ কম কিছু। শোনা যাক অভীক ওসমানের হৃদয় যমুনার বিষ মাখানো বিষাদ।
১. জানতাম না এ শোভন মৃত্যু আসবে কোনোদিন
জেনেও পান করি অমর মৃত্যুবিষ অনির্বাণ আগ্রহে।
২. দুঃখের বাগানের আজ নিরুপম নিঃসঙ্গতার রোদ
কষ্টের ক্ষেতে আজ সরষের সমারোহ।
৩. আমার হত্যায় তুমি কতটুকু রমণীয় নারী
দেখা হল না, আমাদের আর কোনোদিন দেখা হবে না
নস্টালজিয়া যদি এক ধরনের বোধের নাম হয় এবং তাকে যদি বিষাদ থেকে আলাদা করে দেখতে ইচ্ছে হয় সেটিও বোধ হয় সম্ভব। এ কাজটি ওসমান কৃতিত্বের সাথেই করেছেন। প্রিয় কষ্টগুলো সযতনে তুলে রাখেন কবি। ফিরে আসে সেইসব সময় খন্ড আরো মোহনীয় আবেগে- ‘তিন পুলের মাথায় তিরাশির এক সন্ধ্যা’ ‘এই ফুল এই মন্দির’ ‘মেঘ-বাতাসের উৎসব ইত্যাদি এই জাতীয় কবিতা। বিষাদের জার্নাল- ২. বিষাদের জার্নাল- ৩. বিষাদের জার্নাল- ৭ কবিতাগুলো কাব্যিক সৌন্দর্যে উজ্জ¦ল। বইটির দ্বিতীয় প্রচ্ছদ থেকে জানা যায়, ‘একদা কবিতার সবুজ তীর থেকে রাজনীতির কুমির তাকে টেনে নিয়েছিল।
আত্মাঘাতী সে কুমির কি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে? যদি সত্যিই হয় তবে কবিতাপ্রেমীদের কাছে বিষয়টি হবে অত্যন্ত স্বস্তির। কিন্তু ভয় হয় যখন সেই বিষাক্ত কুমিরের বহু স্মৃতিচিহ্ন এই বইয়ে খুঁজে পাই। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না যেয়ে কয়েকটি শব্দ উদ্ধৃত করছি।
ফেরারি জীবন, প্ল্যাকার্ড, ব্যর্থ ফানুস, কুর্নিশ, লিফলেট, সরল সুদ, সহজ কিস্তি, অষ্টম গ্রেড, আবাসিক প্লট, ফেরার যৌবন, রংবাজী, সামস্ত সুখ, উদ্বাস্তু মসৃণ অস্ত্র, ঘাতক, আত্মসমর্পণ, স্লোগান, সম্মিলিত মিছিল, রাজপথ, লড়াকু, সাম্যের ট্রেন ইত্যাদি। নানা স্বাদের অনুভূতি জড়িয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ওসমান বিষাদকেই তুলে দিতে চান পাঠকের হাতে। ওসমান নিরন্তর সৃষ্টিশীল। আপাতত আমাদের এই প্রত্যাশা, ওসমান বিষাদের নীল যমুনা পেরিয়ে আমাদের হাত তুলে দেবেন অমৃত কবিতাকুসুম।