অভিযোগ করলেই বিপদ!

111

রোগীর প্রতি অবহেলা, হাসপাতালের নানা অসঙ্গতি, চিকিৎসকের নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে বাধ্য করা, আয়া-ওয়ার্ডবয়-সুইপার এবং দারোয়ানদের অনৈতিকভাবে টাকা দাবির বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করলে রোগী ও স্বজনদের উপর নেমে আসে বিপদ। রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এ অভিযোগই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কর্তৃপক্ষ অভিযোগ নেয় এবং তদন্ত করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়। তবুও হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রোগী ও স্বজনদের শঙ্কা দূর হয় না।
গত বুধবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গণশুনানিতে এক রোগীর স্বজন এ ধরনের একটি অভিযোগ (ইনজেকশন পুশ করেছেন সুইপার) করার পর হাসপাতাল থেকে রোগীকে জোরপূর্বক ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
সাতকানিয়ার বাসিন্দা শাকেরা বেগম তার মেয়ে কোহিনুর আক্তারকে নিয়ে গত ১৭ মার্চ দুপুরে চমেক হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগে ভর্তি হন। বুধবার (২০ মার্চ) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গণশুনানির আয়োজন করে। সেখানে শাকেরা বেগমের মেয়ে কোহিনুর আকতার অভিযোগ করেন, আমার মাকে তিনটি ইনজেকশন নার্স দিলেও একটি ভুলভাবে পুশ করেন মহিউদ্দিন নামে এক সুইপার। এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সংশ্লিষ্টরা গতকাল শনিবার বেলা ২টায় শাকেরা বেগমের চিকিৎসা শেষ না করে জোরপূবর্ক ছাড়পত্র দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার মেয়ে কোহিনুর আক্তার।
কোহিনুর আকতার বলেন, অভিযোগ দেয়ার পর থেকে আমি যখন মায়ের পাশে থাকতাম না, তখন এখানকার চিকিৎসকরা আমার মাকে নানাভাবে হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন। ওয়ার্ডে দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক আমাকে বলেন, আপনি এভাবে অভিযোগ করলে তো আমরা আপনার রোগীর সাথে ভালো আচরণ করবো না। আর বুধবার অভিযোগ করার পর দুই তিন জন নার্স ও আয়া এসে আমাকে ঘিরে ধরেন। আমি কেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি তা নিয়ে জেরা শুরু করেন। আমি শুধুমাত্র মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি একথা বোঝাতে সক্ষম হওয়ার পর তারা চলে যান।
এ ছাড়া ঘটনার তদন্তের সময় বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. সুলতানা আকতার আমাকে রুমে নিয়ে বলেন, মহিউদ্দিন তো কোনো ইনজেকশন পুশ করে নাই, নার্সরা ইনজেকশন পুশ করেছে বলে আমাকে নানাভাবে হয়রানি করেন। এসময় তিনি আমার রোগীর ভর্তি বাতিল করে দেবেন বলে জানান।
এ ব্যাপারে চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. সুলতানা আকতার পূর্বদেশকে বলেন, রোগীকে জোরপূর্বক ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। রোগীর উন্নতি হওয়ার পর বিভাগের প্রধান ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের অনুমতি সাপেক্ষ ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রোগীকে সেবনের জন্য ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ইনজেকশনও দেওয়া হয়েছে। তিন সপ্তাহ পর আবার ইনজেকশন দিতে হবে।
হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম বলেন, বিকেল ৫টার দিকে কোহিনুর আক্তার নামে এক মহিলা তার রোগীকে জোরপূর্বক ছাড়পত্র দিয়েছে বলে ফোনে অভিযোগ করেছেন। আমরা তাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি।
এদিকে ৩০ ডিসেম্বর পেকুয়ার নেজাম উদ্দিন তার স্ত্রী মোমিনা খাতুনকে (২৫) নিয়ে চমেক হাসপাতালের ৩৩ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করান। গত ৩ জানুয়ারি নবজাতক ও মায়ের জন্য কর্তব্যরত চিকিৎসক বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নির্দিষ্ট প্যাডে কিছু টেস্ট লিখে দেন। এসব টেস্ট করাতে ৩ হাজার ২০০ টাকা মত খরচ হয়। কিন্তু চিকিৎসকের নির্দেশিত ল্যাবে টেস্ট না করায় রিপোর্ট ছিড়ে ফেলা হয়। পুনরায় চিকিৎসকের নির্দেশিত ল্যাব থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা খরচ করে টেস্ট করাতে হয়। এসময় নেজাম উদ্দিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার কাছে ৩ হাজার ২০০ টাকা জোগাড় করা কত কঠিন তা বুঝলো না চিকিৎসক।
শুধু তাই নয়, এসব করুণ চিত্র নিত্যদিন দেখা যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের যেন দেখার কেউ নেই। জীবন বাঁচানোর তাগিদে চিকিৎসা নিতে আসা এসব অসহায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠি কেবলই কতিপয় অসাধু চিকিৎসক, নার্স, আয়া, সুইপার এবং ওয়ার্ডবয়দের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চিকিৎসা সেবা এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও কতিপয় চিকিৎসকের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অর্থের লোভে কিছু চিকিৎসক এখন সেবার চেয়ে ব্যবসাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। যার কারণে এ রকম মহৎ পেশায় জড়িত কতিপয় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রোগীদের অভিযোগের পাহাড়। এই রুগ্নদশা থেকে মুক্তি পেতে হলে চিকিৎসকদের সৎ, নির্লোভ এবং সেবার প্রতি আন্তরিক হওয়ার বিকল্প নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।