অভিযোগের পাহাড় জমছে ইসিতে

49

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত ৩১টি অভিযোগ জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। এসব অভিযোগের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে করেছেন প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীরা। নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগ সমর্থিত ১৫ কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধেই ইসিতে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। আচরণ বিধি অনুযায়ী এসব অভিযোগ নিষ্পত্তি করছেন রিটার্র্নিং কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে প্রার্থীরা যাতে আচরণবিধি মেনে চলেন সেজন্য তাগিদ দিয়েছি। এরপরও কোনো কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীরা। আবার কোনো কোনো প্রার্থীর আচরণবিধি অমান্যের বিষয় গণমাধ্যমে অবগত হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছি। সবমিলিয়ে প্রায় ৩২টি অভিযোগ আমরা নিষ্পত্তি করেছি কিংবা নিষ্পত্তি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রেখেছি। নির্বাচনের আগে পর্যন্ত আমরা আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণে কাজ করবো।’
রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রতীক বরাদ্দের আগে ৭ মার্চ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন স্থানে রঙিন পোস্টার সাঁটানোর বিষয়ে গণমাধ্যম সূত্রে অবহিত হয়ে তা অপসারণ করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবুল কালাম মজুমদার একজন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন মর্মে অভিযোগ দেন চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আনিসুর রহমান। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দিলে তিনি স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে জবাব দেন এবং অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
১৫ নং বাগমনিরাম ওয়ার্ডের বিএনপি দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী চৌধুরী সায়েফুদ্দিন রাশেদ সিদ্দিকি আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে নির্বাচনীয় প্রচারণা বন্ধের হুমকি ও অফিস ভাঙচুরের অভিযোগ তুলেন। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার নির্দেশে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে ডেকে সতর্ক করা হয়। ১১ নং সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী ফেরদৌসি আকবার অভিযোগ করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জিনাত আরা বেগম দলীয় পরিচিতি ব্যবহার করে পোস্টার ছাপিয়েছেন এবং বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। এ অভিযোগ নিষ্পত্তিকালে দুই প্রার্থীকেই আচরণবিধি মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয় এবং অভিযুক্ত প্রার্থীকে সতর্ক করা হয়েছে।
২৫ নং রামপুর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুস সবুর লিটনের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন, রাজনৈতিক দলের পরিচিতি ও অন্য ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করার অভিযোগ তুলেন বিদ্রোহী প্রার্থী এসএম এরশাদ উল্লাহ। পরে অভিযুক্ত প্রার্থী লিটনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়ার পাশাপাশি পোস্টার ও ব্যানার অপসারণ করা হয়। ১৩ মার্চ এসএম এরশাদ উল্লাহ আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আবদুস সবুর লিটনের বিরুদ্ধে কর্মী সমর্থক কর্তৃক দেশিয় অস্ত্রসহ হামলা ও হিংসাত্মক কর্মকান্ডের অভিযোগ তুলেন।
আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী যানবাহনসহ শোভাযাত্রা করে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর একটি সংবাদ জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হলে অভিযুক্ত প্রার্থীকে আচরণবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়। একই প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণায় সার্কিট হাউজ ও সরকারি গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ তুলেন চট্টগ্রাম নাগরিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব প্রফেসর নছরুল কাদির। অভিযোগের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হলে তা তদন্ত করে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দেন কোতোয়ালী থানা পুলিশ। বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আবদুল্লাহ আল নোমান আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও পোস্টার ছিড়ে ফেলার অভিযোগ দেন। অভিযোগটি দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সকল থানার অফিসার ইনচার্জদের কাছে পাঠানো হয়।
২১ নং জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আবু মো. মহসীন চৌধুরী অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি কর্তৃক ব্যানার ছিড়ে ফেলা ও অস্ত্র প্রদর্শন করে হত্যার হুমকির অভিযোগ তুলেন এবং অভিযোগের ব্যবস্থা নেয় কোতোয়ালী থানা পুলিশ। ২২ নং এনায়েত বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সলিম উল্লাহ বিএনপি প্রার্থী আবদুল মালেকের বিরুদ্ধে শারীরিক আঘাত ও হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগ তুলেন। ৩ নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী জেসমিন পারভীন জেসী, ৪ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী তছলিমা বেগম (নুরজাহান) ও ৮ নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নীলু নাগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে প্রচারণা চালানো নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তিনজনকেই পত্র প্রাপ্তির ৪৮ ঘন্টার মধ্যে জবাব দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ৩ নং পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের কফিল উদ্দিন খান, ৮ নং শুলকবহর ওয়ার্ডের মোরশেদ আলম, ১৪ নং লালখানবাজার ওয়ার্ডের আবুল হাসনাত বেলাল, ১৫ নং বাগমনিরাম ওয়ার্ডের মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, ২১ নং জামালখান ওয়ার্ডের শৈবাল দাশ সুমন, ২২ নং এনায়েত বাজার ওয়ার্ডের সলিম উল্লাহ, ২৫ নং রামপুর ওয়ার্ডের আবদুস সবুর লিটনের বিরুদ্ধে ইসিতে অভিযোগ আনা হয়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত এসব প্রার্থীদের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয় এবং আচরণবিধি মেনে চলার বিষয়ে অঙ্গীকারের প্রেক্ষিতে সতর্ক করা হয়।
২৭ নং দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মো. শেখ জাফরুল হায়দারের বিরুদ্ধে নির্ধারিত আকারের বড় পোস্টার মুদ্রণ, রাজনৈতিক দলের পরিচিতি ও অন্য ব্যক্তির ছবি ব্যবহারের অভিযোগ তুলেন প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী এইচ.এম সোহেল। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এ অভিযোগের জবাব দেয়ার জন্য অভিযুক্ত প্রার্থীকে নির্দেশনা দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
৩৫ নং বক্সিরহাট ওয়ার্ডের বিএনপি দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী তানজিরুল হকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার ও ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকির অভিযোগ দেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হাজী নুরুল হক। অভিযোগের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাকলিয়া থানাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৩৮ নং দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে সল্টগোলা ক্রসিং চত্বরে প্রার্থী ও কর্মী সমর্থকদের উপর হামলার অভিযোগ করেন মোহাম্মদ হাসান মুরাদ। অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রদানের জন্য বন্দর থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
১১ নং দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের আওযামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী মো. ইসমাইলের বিরুদ্ধে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীকে হুমকি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি এবং রাজনৈতিক দলের পরিচিতি ব্যবহার করার বিষয়ে দুটি অভিযোগ করেন মোর্শেদ আকতার চৌধুরী। এরমধ্যে একটি অভিযোগের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পাহাড়তলী থানাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অপর অভিযোগের বিষয়ে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জবাব দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
১২ নং সরাইপাড়া ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী মো. নুরুল আমিন প্রতিদ্ব›দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থী মো. সাবের আহমদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদান, অস্ত্র প্রদর্শন করে হুমকি প্রদানের অভিযোগ করেন। গতকাল জমা দেয়া অভিযোগটি দুই কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন প্রদানের জন্য ডবলমুরিং থানাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
২২ নং এনায়েতবাজার ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ সলিম উল্লাহর বিরুদ্ধে বিএনপি দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আবদুল মালেক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা, পোস্টার ছিড়ে ফেলার অভিযোগ আনেন। গতকাল জমা দেয়া অভিযোগটি দুই কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন প্রদানের জন্য কোতোয়ালী থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সাতজন মেয়র প্রার্থী, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৬৩ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৫৬ জন প্রার্থী মিলিয়ে মোট ২২৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। নির্বাচনে মোট ভোটার ১৯ লক্ষ ৫১ হাজার ৫২ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার নয় লক্ষ ৯৮ হাজার ৭২৩ জন ও নারী ভোটার নয় লক্ষ ৫২ হাজার ৩২৯ জন। ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৩৫টি। চার হাজার ৮৮৬টি কক্ষে ভোটগ্রহণে দায়িত্ব পালন করবেন ৭৩৫ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, চার হাজার ৮৮৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও নয় হাজার ৭৭২ পোলিং কর্মকর্তা।