অব্যবস্থাপনায় ভরা রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল রোগীদের নানা অভিযোগ

37

রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে বিরাজ করছে চরম অব্যবস্থাপনা। কর্তব্যে অবহেলা করেন কর্মরত চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। অবহেলার শিকার সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীর স্বজনরাও। সরেজমিনসহ অনুসন্ধানে এসব তথ্যচিত্র পাওয়া গেছে।
হাসপাতালটির নজরদারি নেই নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কথা শোনেন না চিকিৎসক, সহকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাদের সব সময় দায়িত্বে অবহেলা। চাপ দিলে বদলি হয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। অনেকে চাকরি ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেন। তা ছাড়া দূষণের শিকার হচ্ছে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের পরিবেশ।
দেখা গেছে, গোটা হাসপাতালের পরিবেশ নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত। টয়লেটে মলমূত্রে অপরিচ্ছন্ন হওয়ায় দূষণের শিকার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। ময়লা ও দুর্গন্ধে ভরে গেছে ওয়াশ ও বার্থরুম। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের অসুস্থতা আরও বেড়ে যায়। রোগীদের খাবার দেয়া হয় নিম্নমানের। সকালে দেয়া হয় পাউরুটি, সিদ্ধ ডিম আর দুটি বাংলা কলা। দুপুরে ও সন্ধ্যায় দেয়া হয় মোটা চালের ভাত, এক টুকরো মাছ বা বয়লার মুরগির মাংস আর সবজি।
সরেজমিনকালে রোগী, তাদের স্বজন ও সংশ্লিষ্টরা জানান, চিকিৎসা নিয়ে অবহেলার শিকার রোগীরা। বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ নেই। চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন লিখে দেন। ওষুধ আনতে হয় বাইরের ফার্মেসি থেকে। রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় বাইরে। রোগীদের নিয়মিত দেখতে যান না চিকিৎসকরা। দেখতে গেলেও রোগের বিস্তারিত শুনতে চান না চিকিৎসকরা। রোগীর ফাইল দেখেন কেবল নামে। ঔষধ লিখে দিয়ে সেগুলো খাওয়ানোর নির্দেশনা দিয়ে যান কেবল।
হাসপাতালে ভর্তি পুরুষ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগী দীপক দেব (৩৭), আবদুল মালেক (৬৪), কাইয়ুব আলী (৩৫) এবং গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি আমেনা বেগম (২৫)ও ও রিনা চাকমা বলেন, আমরা ভর্তি হয়েছি চিকিৎসা সেবা নিতে। কিন্তু উপযুক্ত সেবা মিলছে না। বেশিরভাগ ওষুধ কিনে আনতে হয় বাইর থেকে। সামান্য ওষুধ দেয়া হচ্ছে হাসপাতাল থেকে। রোগীর চিকিৎসা ও সেবারমান বাড়ানো দরকার। আসন সংখ্যা কম। নার্স, চিকিৎসকের উপস্থিতি কম। পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ করা দরকার।
দেখা গেছে, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগিরা বিছানা না পেয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন, মেঝেতে ভর্তি হয়ে। শিশু ও সাধারণ ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত রোগী ভর্তি। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ শ্বাসকষ্ট , ডায়রিয়া, জন্ডিস, ডায়াবেটিস ও সর্দি-কাশির রোগী। রোগী ও তাদের স্বজন অনেকে বলেন, নিয়মিত চিকিৎসক না থাকায় জরুরি মুহূর্তে প্রায় সময় জরুরি বিভাগের চিকিৎসককে ডেকে আনতে হয়। তখন আবার রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে ভালো আচরণ করনে না চিকিৎসকরা। নার্স ও আয়াদের দুর্ব্যবহার তো আছেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় সময় হাসপাতালে চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন। চিকিৎসকরা বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন, নিজেদের চেম্বারে ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক চিকিৎসা নিয়ে। তারা সরকারি চাকরির প্রতি নজর দেন না। বেতন তো মাসে মাসে পাচ্ছেন। কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। বিনাবাধায় প্রাইভেট চিকিৎসায় মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করে যাচ্ছেন তারা।
জানা যায়, রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে প্রয়োজনীয় জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসও পর্যাপ্ত নয়। আছে মাত্র একটি অ্যাম্বুলেন্স। ইসিজি, অ্যাক্সরে মেশিন ও আলট্রাসনোগ্রাফি থাকলেও সেগুলো উন্নতমানের নয়। অপারেশনের রোগীদের জন্য নেই উপযুক্ত ওটি বা অস্ত্রোপচার ব্যবস্থা। নেই প্যাথলজিক্যাল সুবিধা। রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হয় বাইরে গিয়ে। এছাড়াও জনবল, বিদ্যুৎ, পানিসহ নানা সংকট রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে। উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবে সামান্য কিছুতে চট্টগ্রাম, ঢাকায় পাঠানো হয় রোগী। এতে নানা হয়রানিসহ ঝুঁকির সম্মুখীন হন রোগী ও তাদের স্বজনরা। জরুরি মুহূর্তে এবং যথাসময়ে নিয়মিত চিকিৎসা না পেয়ে চরম ঝুঁকিতে পড়েন অনেক রোগী। বহির্বিভাগে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও চিকিৎসক ও চিকিৎসা মেলে না। জরুরি বিভাগে রোগী ভর্তি নিয়ে স্বজনরা পড়েন বিড়ম্বনায়। নার্স ও স্টাফদের অবহেলায় অসহায় হয়ে পড়েন রোগীরা। ১০-১২ চিকিৎসকের পদ শূন্য। চিকিৎসা সহকারী ও কর্মচারীর অনেক পদ খালি। সংযুক্ত মেডিকেল কলেজের শিক্ষকরা হাসপাতালে চিকিৎসসেবা দিতে যান না।
এ সময় হাসপাতালে কর্তব্যরত শিশুবিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এমএহাই বলেন, বর্তমানে ডায়রিয়া ও সর্দি কাশির রোগী বেশি দেখা যাচ্ছে। তাদেরকে যথাপোযুক্ত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে হাসপাতালে জনবল সংকসহ কিছু কিছু সমস্যা তো আছে।
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. শওকত আকবর বলেন, আমি ২৪ ঘন্টা হাসপাতালে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি। রোগী ও তাদের স্বজনরা যেসব অভিযোগের কথা বলছেন, সেগুলোর সবকিছু সঠিক ও সত্য নয়। আগের চেয়ে বর্তমানে হাসপাতালের পরিবেশ ও চিকিৎসাসেবার মান অনেক উন্নত হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা থাকায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।